পরিবহন ধর্মঘটে অটোরিকশা চালকদের ‘পোয়াবারো’

দেবাশীষ চক্রবর্তী, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
পরিবহন ধর্মঘটে অটোরিকশা চালকদের ‘পোয়াবারো’

হাটহাজারীর সরকার হাট এলাকার বাসিন্দা লিটন চৌধুরী। থাকেন শহরে, যাবেন গ্রামের বাড়িতে। সকাল ১০টায় তিনি এসেছিলেন নগরীর অক্সিজেন মোড় এলাকায়। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের কথা আগে থাকা না জানায় পড়েছেন বিপদে। টানা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও মেলেনি হাটহাজারীর বাস। তবে, অটোরিকশা পেলেও ভাড়া চাচ্ছে দ্বিগুণ।

অক্সিজেন মোড়ে লিটন চৌধুরী ভাড়া নিয়ে তর্ক করছিলেন অটোরিকশা চালকের সাথে। লিটন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘৪০-৫০ টাকার ভাড়া বাস না চলায় ৯০ টাকা চাচ্ছে ওরা (সিএনজি)। বুঝতে পারছেন দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? সুযোগে যে যাকে পারে তাকেই জিম্মি করে। সকাল সাড়ে ৮টায় এসে এখন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু বাস নেই। ধর্মঘট করে আমরা সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে কি মজা পায় তারা?'

তবে, শুধু যে লিটন চৌধুরী এমন ক্ষুব্ধ তা নয়। রবিবার (২৮ এপ্রিল) নগরের অক্সিজেন মোড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে শিশু, বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের দুর্ভোগ। তারাও ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন।

নগরের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা শহিদ হোসেন অসুস্থ মাকে দেখতে যাচ্ছিলেন রাউজান উপজেলার গহিরা এলাকার গ্রামের বাড়িতে। ক্ষুব্ধ এই বেসরকারি চাকরিজীবী সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘দেশে এখন মগের মুল্লুক চলছে। গণপরিবহন ধর্মঘটে সুযোগ নিচ্ছে সিএনজি ও টেম্পু চালকরা‌। নতুন পাড়া থেকে রাউজান মুন্সিরহাটা পর্যন্ত লোকাল সিএনজি ভাড়া ৫০-৬০ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু আজকে ৮০-৯০ টাকা কমে ভাড়া নেই এখানে।' 

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাহসিন বলেন, ‘সকালে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে হাটহাজারী থেকে এসেছি। আজ দেরিও হয়ে গেছে স্কুলের। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামমুখী কোনো বাস পাইনি আসার পথে। যাওয়ার সময় কিভাবে যাব বুঝছি না।'

নগরের ইপিজেড এলাকা থেকে বাসে ফটিকছড়ি যাচ্ছেন মনসুর আহমদ। তিনি বলেন, ‘১০০ টাকা সিএনজি ভাড়া এখন ১৪০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এভাবে মানুষকে জিম্মি করার কোনো কারণ নেই। আমরা সাধারণ মানুষের যেন কোনো দাম নেই। যে যেভাবে পারে আমাদের ওপর জুলুম করে যাচ্ছে।’

তবে, বাড়তি ভাড়া নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সিএনজিচালকরাও। ফটিকছড়ি রুটে সিএনজিচালক লালা মিয়া সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এখানে সবাই বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। আমি একা একজন ড্রাইভার ভাড়া কম নিলে কালকে এই রাস্তায় সিএনজি চালাতে পারবো না। এখানে অনেক হিসেব আছে যা আপনারা খোঁজ নিলে জানবেন।'

এদিকে, নগরের শাহ আমানত সেতু এলাকায় ভিড় জমেছে হাজারও যাত্রীর। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। তবে বাসের দেখা নেই। বাস না থাকার সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে ব্যস্ত অন্যান্য যানবাহনগুলো। আর সেই গাড়িগুলোতেও উপচেপড়া ভিড়। গাড়ি না পেয়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হচ্ছেন; আবার কেউ অতিরিক্ত ভাড়ায় অন্য কোনো বাহনে চেপেছেন।

ব্রিজ এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা শরীফ উদ্দিন নামের এক যাত্রীর সাথে কথা হয় সিভয়েস২৪ প্রতিবেদকের। ভোগান্তির প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘নিউ মার্কেট যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তিন ঘণ্টা আগে। রাস্তায় নেমে একটি বাসও পাইনি। গ্রাম (কোলাগাঁও) থেকে কোনো রকমে সিএনজি করে মইজ্জারটেক এসেছিলাম। সেখানেও গাড়ি পাইনি। আর যা পেয়েছিলাম তা বাড়তি ভাড়া দাবি করেছে। পরে পায়ে হেঁটে ব্রিজ পার হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিজ পার হয়েও শান্তি নেই। মার্কেটে যাওয়ার জন্য যে গাড়িগুলো এখানে থাকতো; সেগুলোও আজ যাচ্ছে না। তারা না যাওয়াতে অন্যান্য গাড়ির চালকরা বাড়তি ভাড়া দাবি করছেন।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে হাসান কুতুব নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘এ দেশে কিছু একটা হলেই যাত্রীদের জিম্মি করে পরিবহন চালকরা। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজ খোলার প্রথম দিন হওয়াতে শিক্ষার্থীরাও দুর্ভোগে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের কথাও কেউ চিন্তা করে না; গাড়ি বন্ধ থাকলেও তারা (পরিবহন শ্রমিক) ঠিকই চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আমরা তো কষ্টে পড়ে যায়। দিনশেষে সাধারণ মানুষরাই কষ্টের মুখে পড়ে।’

যাত্রীদের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ মুছা সিভয়েস২৪-কে বলেন, 'এই গরমের মধ্যে যাত্রী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষদের কষ্টে আমিও কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ধর্মঘট কেন? আমরাতো একদিনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেইনি। কিন্তু আমরা বারবার চেষ্টা করেছি প্রশাসনের সাথে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধান করার। কিন্তু যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, পরদিন আমাদের দুইজন শ্রমিক নেতাকে আটক করে পুলিশ। এরপর পাঁচদিন ধরে টানা লাইন বন্ধ। যারা ওই রুটে গাড়ি চালায় তারা সবাই শ্রমিক। তারা কিভাবে চলবে?' 

তিনি আরও বলেন, 'আমরা বারবার চেষ্টা করেছি ধর্মঘট না দিয়ে সমঝোতার মধ্য দিয়ে মিমাংসা করতে। কিন্তু বৈঠকও করেনি কেউ আমাদের সাথে। আর আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক যে মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে... এগুলো মামলা হওয়ার আগে যদি আমার শ্রমিককে ধরে নিয়ে গিয়ে তারই সহকারীকে দিয়ে মামলা করান তাহলে আমাদের কি করার? আমাদের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এগুলো করা হচ্ছে।'

প্রসঙ্গত, শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে জরুরি সভা শেষে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বাসের ধাক্কায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহতের জেরে গাড়ি পোড়ানোর প্রতিবাদে চার দফা দাবিতে রবিবার (২৮ এপ্রিল) সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দেয় বৃহত্তর গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

এর আগে, ২২ এপ্রিল ওই ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এতে আহত হন আরও এক শিক্ষার্থী। এই ঘটনার প্রতিবাদে টানা চারদিন সড়ক অবরোধ করে চুয়েট শিক্ষার্থীরা। এতে ৩টি বাস পুড়িয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে পরিবহন শ্রমিকেরা।

অপরদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আগামী ১১মে পর্যন্ত চুয়েট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) বিকেলে চুয়েট সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সময়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করতে পারবেন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়