Cvoice24.com

বাসে একই গন্তব্যে একেক দিনে একেক ভাড়া

রবিউল রবি, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ২ এপ্রিল ২০২৪
বাসে একই গন্তব্যে একেক দিনে একেক ভাড়া

আবুল খায়ের গ্রুপের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জব্বার। ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রাম থেকে সপরিবারে মাগুরার গ্রামের বাড়িতে যাবেন তিনি। কাউন্টারে কাউন্টারে ঘুরেও টিকিট পাচ্ছিলেন না। শেষমেশ যে কাউন্টারে টিকিট পেলেন সেখানেও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি! তাঁর কাছ থেকে ১১শ টাকার ভাড়া চাওয়া হচ্ছে ১৬শ’ টাকা। গত শনিবার নগরের অলংকার মোড়ে বাস কাউন্টারের সামনে চিত্র ছিল এমনই।

শুধু কাউন্টারে নয় অনলাইনেও বিলাসবহুল বাসের টিকেট ঈদের টিকিটে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ৮শ’ থেকে ১২শ’ টাকা। ঈদকে ঘিরে পরিবহন খাতে এমন নৈরাজ্য চললেও এখনো ‘নিরব’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), স্থানীয় প্রশাসন, ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। যাত্রীর অভিযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা!

বাস মালিক কর্তৃপক্ষ ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই বললেও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, লোকসান কমাতে বাধ্য হয়েই বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে।

তাদের দাবি, চট্টগ্রাম থেকে বাসভর্তি যাত্রী পেলেও ফিরতি পথে পুরো বাস খালি আসবে। ফলে জ্বালানি খরচও ওঠবে না তাদের।

অধিকাংশ কাউন্টারে টাঙানো হয়নি ভাড়ার তালিকা

এবারের ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিলের টিকিটের। এর মধ্যে ৮ এপ্রিলের টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাই ওই দিনের টিকিট যাত্রীরা কিনছেন চড়া মূল্য দিয়ে। তবে অধিকাংশ কাউন্টারেই টাঙানো হয়নি ভাড়ার তালিকা।

আগামী ৮ এপ্রিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় যাবেন নয়াবাজারের বাসিন্দা মো. আরিফ হোসেন। স্ত্রীসহ দুজনের টিকিট কাটতে এসেছিলেন নগরের অলংকার মোড়ে। ‘আরটি এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, স্বাভাবিকসময়ে তিনি ৯শ’ থেকে হাজার টাকায় বলেশ্বর, হাসানস ট্রাভেলস বা আলিফ পরিবহনের টিকিট কিনলেও তার কাছে এখন ১৮শ’ টাকা দাবি করা হচ্ছে প্রতি টিকিটের জন্য।

আরিফ হোসেন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমি মূলত এসেছিলাম সৌদিয়া বা ইউনিক বাসের টিকিটের জন্য। কিন্তু ৮ তারিখের টিকিট কোথাও পাইনি। তাই বলেশ্বরের টিকিট কাটতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার কাছে স্বাভাবিকের তুলনায় ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা বেশি চাইছে।’

‘আরটি এন্টারপ্রাইজ’ নামক কাউন্টারে যাত্রী বেশে ভাড়া জানতে চাইলে এক বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘এমনে ভাড়া ১১শ’ টাকা। আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার করে রাখা যাবে। ৪ এপ্রিল থেকে বাড়তি ভাড়া শুরু। ৪ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ১৩শ’ টাকা, ৭ তারিখে ১৭শ’ টাকা আর ৮ বা ৯ তারিখ গেলে একদাম ১৮শ’ টাকা রাখা যাবে।’

ভাড়া এত বাড়তি কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় বাড়তি ভাড়া নেয় এটা সবাই জানে। যাওয়ার সময় যাত্রী ভরা থাকলেও আসার সময় বাস খালি আসে। তাই কিছু করার নেই। গেলে বাড়তি ভাড়া দিয়েই যেতে হবে। পরে আসলে আর টিকেট পাবেন না।’

যদিও ভাড়া বাড়তি নয় বরং সরকার নির্ধারিত মূল্যেই রাখা হচ্ছে বলে দাবি করছেন বলেশ্বর পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মোহাম্মদ মহিদুল ইসলাম।

তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘মূলত আমাদের সরকার নির্ধারিত চট্টগ্রাম থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ভাড়া ১৭১১ টাকা। সেখানে আমরা অন্যান্য সময় আদায় করি ১১০০ টাকা। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা যে আমরা অন্যান্য সময়ে কম রাখি। ঈদের সময়ে দেখা যায় ২০ রমজান পর্যন্ত পরিবহন মালিকরা লাখ দুই টাকা লোকসান গুনে। কারণ যাত্রী থাকে না। আর ঈদের আগে-পরে ৬ দিন যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। ফলে আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করেই লোকসান পুষিয়ে নিই। ১৮০০ টাকা কোনোভাবেই বাড়তি ভাড়া নয়।’   

‘আজ গেলে ৯০০, ৮ তারিখ ১৫০০’

রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর এ.কে খানে সেন্টমার্টিন ট্রাভেলস এর একটি বাস কাউন্টারে গিয়ে কথা হয় বিক্রয়কর্মী মো. রকির সাথে। যাত্রীবেশে তাঁর কাছে ঢাকার ভাড়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজকে গেলে এসি ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া পরবে ৬৮০ টাকা। রেট ভাড়ার থেকেও কম। আর এসি স্লিপারের ভাড়া ৯শ’ দিলেই হবে।’

একই গন্তব্যে একই বাসে আগামী ৮ তারিখ গেলে টিকেটের দাম কত রাখা যাবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন গেলে অনেক কম রাখা যাবে। কিন্তু ৪ তারিখের পর থেকে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে। ওইদিন থেকে অনলাইনে টিকেট বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। ওইসময় এসি ইকোনোমি ক্লাস ১ হাজার আর এসি স্লিপার কোচে ১৫শ’ টাকা রাখা যাবে।’

ভাড়া বেশি হয়ে গেল কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘আরে ভাই, ঈদের সময় আপনাকে বুঝতে হবে। দশ জনের যেই গতি আপনারও একই গতি হবে। বুঝেন না কেন? বাড়তি আপনার থেকে এক টাকাও নিব না। ঈদে এটাই রেট ভাড়া।’

অনলাইন প্লাটফর্ম সহজেও ‘কঠিন’ হিসাব

অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমে প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে বাসের অগ্রিম টিকিট। গত শনিবার এই প্রতিবেদক বিভিন্ন রুটের টিকিটের দাম যাচাই করেন। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীগামী এভারগ্রিন ট্রান্সপোর্টের একটি বাসের টিকিটের মূল্য তারিখ এবং সিটের মানভেদে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

গত শনিবার রাত ৮টার দিকে দেখা যায়, ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী গামী এভারগ্রিন ট্রান্সপোর্টের একটি বাসে সিট রয়েছে মোট ৩৬টি। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাস সিটের টিকিটের মূল্য ১৫০০ টাকা এবং একই বাসের স্পেশাল সিটের টিকিটের মূল্য ১৮০০ টাকা।

একই গন্তব্যে একই ভাড়া ৩ তারিখ পর্যন্ত দেখা গেলেও ওই বাসে ৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি। আগামী ৪ এপ্রিল এভারগ্রিন ট্রান্সপোর্টের ওই বাসটিতে বিজনেস ক্লাস টিকিটের মূল্য ১৫০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৭০০ টাকা। অর্থাৎ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১২০০ টাকা।

এদিকে, একই বাসে স্পেশাল ক্লাসের সিটের মূল্য যেখান ১ এপ্রিল ১৮০০ টাকা ছিল সেখানে আগামী ৪ এপ্রিলের টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০০ টাকা। একই গন্তব্যে একই বাসে শুধু তারিখের ব্যবধানে এই সিটের টিকিট কাটতেও যাত্রীদের গুনতে হবে বাড়তি ১২০০ টাকা বাড়তি ভাড়া।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে এভারগ্রিন ট্রান্সপোর্টের অফিসিয়াল নম্বরে (০১৮৯৪-৭০৮১৯৯) একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

যা বলছে মালিক সমিতি

বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সচিব মনোয়ার হোসেন রবিবার সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ভাড়া বেশি নিলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবশ্যই তদারক করা উচিত। আমরা ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করি। আজকেও সরকার ডিজেলের দাম কমিয়েছে। কাজেই ভাড়া বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। আমি আগামীকাল থেকে প্রত্যেকটি কাউন্টারে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট টাঙানো বাধ্যতামূলক করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একাধিকবার বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে বাস মালিকদের সাথে বৈঠক করেছি। তারা বলে, আমরা যাচ্ছি পুরো গাড়িভরা যাত্রী নিয়ে কিন্তু আসতে হচ্ছে খালি। তাইলে আসার সময় আমাদের ফুয়েল কস্ট (তেল খরচ) পুরোটাই লস। তাইলে এই লোকসান তারা পোষাবে কিভাবে—এটাও একটি প্রশ্ন।’

‘আমাদের পকেট সড়কগুলো বাদে মূল সড়কে রুট আছে মোট ১১০টির মতো। এবারের ঈদে এসব সড়কে দৈনিক অন্তত ১২শ’ গাড়ি চলছে। এ হিসেবে দৈনিক ৫০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ ঈদের আগে-পরে আসা যাওয়া করবে বলে আমরা আশা করছি।’ যোগ করেন তিনি।

গায়ের পাশেই বাড়তি ভাড়া আদায়, অভিযোগের অপেক্ষায় অধিদপ্তর!

ভোক্তাদের অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি এবং ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে আধা-বিচারিক সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চট্টগ্রামে এই সংস্থাটির অফিস নগরের ইপিজেড থানার এম এ আজিজ রোডের টিসিবি ভবনে।

অফিসের ঠিক আড়াইশ মিটারের মধ্যেই ইপিজেড থানার পাশে রয়েছে কয়েকটি দূরপাল্লার বাস কাউন্টার। সেখানেও হরদম নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। গায়ের পাশেই ভোক্তাদের কাছ থেকে ঈদযাত্রায় এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও কোনো নজর নেই সংস্থাটির। বরং তারা অপেক্ষায় আছে যাত্রীদের অভিযোগের।

সরেজমিনে ইপিজেড থানার পাশ্ববর্তী বাস কাউন্টারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণবঙ্গের সবকটি রুটে বলেশ্বর, আলিফ, জিএস ট্রাভেলসের ব্যানারের গাড়িতে যাত্রীদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

মাসুম বিল্লাহ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘আমি পটুয়াখালীর টিকেট কাটতে এসেছিলাম। এসে দেখি স্বাভাবিকের চেয়েও বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। অথচ এখান থেকে কয়েক কদম হাঁটলেই ভোক্তা অধিকারের অফিস। তারা কি এগুলো দেখে না? আমরা যাত্রীরা এভাবেই ঈদ আসলে অসহায় হয়ে পড়ি।’

হাসপাতাল গেইট এলাকার কাউন্টারের সামনে কথা হয় পোশাক শ্রমিক মো. মামুনের সাথে। হতাশার সুরে তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘৮ এপ্রিল গ্রামের বাড়ি রংপুর যেতে চেয়েছিলাম। আমার এক মেয়ে আর দুই ছেলে থাকে সেখানে। বিপুল পরিবহনের বাসে এমনিতে ভাড়া নেয় ১৩০০ টাকা করে। কিন্তু এখন চাইছে দুই হাজার টাকা। এখন বাড়তি ভাড়া দিয়েই যেতে হচ্ছে।’

রাজশাহীর যাত্রী ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমি গ্রামীণ ট্রাভেলসের টিকেট কেটেছি ৯ তারিখের। চেয়েছিলাম ৮ তারিখের কাটতে কিন্তু পাইনি। এমনিতে ভাড়া ১২৫০ টাকা। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে ১৫৫০ টাকা করে নিচ্ছে। কম বেতনে চাকরি এর ওপর ঈদের বাজার। যাতায়াতেও যদি এভাবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। আমরা যাত্রীরা আসলেই অসহায়।’

নগরজুড়ে এমন বাড়তি ভাড়ার ‘তামাশা’ চললেও ঘুমিয়ে আছে ভোক্তা অধিদপ্তর। ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়তি ‘নজরদারি’ও নেই সংস্থাটির। তবে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ। তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। যাত্রীদের বলেন আমাদের কাছে অভিযোগ করতে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিশকাতুল তামান্না সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। কিন্তু ভাড়ার বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে আমরা বিভিন্ন বাস টার্মিনালগুলোকে ফোকাস করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবো। এ সময় বাড়তি ভাড়া নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়