‘একা’ মিশন, এমপির ‘হাত’ আনোয়ারের মাথায়

আহমেদ সারজিল, সন্দ্বীপ ঘুরে এসে

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ৫ মে ২০২৪
‘একা’ মিশন, এমপির ‘হাত’ আনোয়ারের মাথায়

২৮ এপ্রিল (রবিবার) সন্ধ্যা ৬ টা। সন্দ্বীপ উপজেলা কমপ্লেক্স। একটু আগেই উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আনোয়ারের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধন হয়েছে। কার্যালয়টি ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর ঢল। অফিসের ভেতর-বাইরে এমনকি মূল সড়ক ছাড়িয়ে আশপাশের অলিগলিতেও জটলা বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতাদের। ঠিক একই সময়ে ওই অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মাইনউদ্দিন মিশন। তবে সেদিকে তাকানোর যেন সময় কিংবা আগ্রহ কোনোটাই নেই উপস্থিত নেতাকর্মীদের। দলীয় নেতাকর্মীদের কাউকে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ও করতে দেখা গেল না। ওই সময় পৌরসভা এলাকায় প্রচারণা শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন মিশন।

আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থা এমনই। দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন সবাই। আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিতব্য সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পাঁচ প্রার্থী থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে শোরগোল তাঁদের দুজনকে ঘিরেই।

নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিতে নিষেধ করা হয়েছে সংসদ সদস্যদের ৷ এমনকি তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও নির্বাচনে প্রার্থী হতে না করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের মাঠের চিত্র ভিন্ন। 

নির্বাচনে এস এম আনোয়ার হোসেনকে স্থানীয় এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা সমর্থন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা পর্যায়ে নিজের ক্ষমতার বলয় ধরে রাখতে নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছেন তিনি। তবে সরাসরি মাঠে না নামলেও ইশারায় দিচ্ছেন নির্দেশনা। যা স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের নানা কার্যক্রমে আভাস মিলছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দ্বীপের প্রায় সব জায়গায় ছেয়ে গেছে আনারস প্রতীকে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এস এম আনোয়ার হোসেনের পোস্টার-ব্যানারে। তাঁর সাথে জোট বেঁধে প্রচারণা চালাচ্ছেন ফুটবল প্রতীকের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হালিমা বেগম শান্তা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা। নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধনেও দেখা গেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতা কর্মীদের। অন্যদিকে প্রচারণায় থেমে নেই কাপ-পিরিচ প্রতীকের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাঈন উদ্দীন মিশনও। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীর অনেককে সঙ্গে না পেলেও তিনি জোরেশোরে চালাচ্ছেন প্রচারণা। 

গুঞ্জন রয়েছে, এবারের উপজেলা নির্বাচনে মাঈন উদ্দীন মিশনকে নির্বাচনে অংশ নিতে বারণ করেছিলেন এমপি নিজেই। সেই অনুযায়ী গত ১৫ এপ্রিল দুপুর ২টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি মিশন। কিন্তু পরে তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করলে উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এস এম আনোয়ার হোসেনের পক্ষে মাঠে নামেন।  

এই গুঞ্জনের সত্যতা মিলেছে এমপির আশির্বাদপুষ্ট বলে পরিচিত আনোয়ার হোসেনের বক্তব্যে। সোমবার (২৯ এপ্রিল) সন্তোষপুর ইউনিয়নে এক পথসভায় তিনি বলেন ‘অনেকে বলেন এখনো কোনো সিগন্যাল পাইনি। আবহাওয়া তো ভালো। সিগন্যালের কী দরকার। যাকে যাকে বলার এমপি মহোদয় বলে দিয়েছেন।’ 
 
উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মিশন ভাই ছিলেন এমপি সাহেবের দুঃসময়ের কর্মী। আনোয়ার ভাইয়ের সাথে আগে থেকে মনোমালিন্য ছিলো। হঠাৎ এমন কি হলো যে নিজের এমন কাছের লোককে সরিয়ে দিয়েছেন।’ 

এদিকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন শুধুমাত্র একজন, তিনি ওমর ফারুক। আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিনা ভোটে জিতে ঘোষণার অপেক্ষায় আছেন ওমর। পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থী হিসেবে তাকে সমর্থন দেন এমপি মিতা। তিনি এমপি মিতার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স সন্দ্বীপ শাখার পরিচালক। অন্যদিকে মিতা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দিয়েছেন ফুটবল প্রতীকের হালিমা বেগম শান্তাকে। 

২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার শাহজাহান বিএর মৃত্যুতে উপজেলা চেয়ারম্যানের শুন্যপদে ভোট হলে দলীয় প্রতীকে মাঈন উদ্দীন মিশনকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে কাজ করেন এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা। আর বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন সন্দ্বীপ মুজিব বাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে মিশনকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার অভিযোগও উঠে। 
 
জানতে চাইলে মাঈন উদ্দীন মিশন সিভয়েস২৪কে বলেন, ‘এমপি মহোদয়ের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। কেন যে উনি এমন করছেন আমি বুঝতে পারছি না। নমিনেশেন জমা দেওয়ার কিছুদিন আগে উনি যখন সন্দ্বীপ থেকে যাচ্ছিলেন, আমি এমপি মহোদয়কে ঘাটে বিদায় দিতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন, এবারের নির্বাচনে আপনি নমিনেশন সাবমিট কইরেন না। এটা বলেই উনি স্পিড বোটে উঠে গেলেন। পরবর্তীতে আমার আত্মীয়স্বজন ও নেতাকর্মীরা আমাকে বলে নমিনেশন জমা দিতে। তাই আমি জমা দিয়েছি।’ 

আনোয়ার হোসেনের প্রতি এমপির সমর্থনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওনাকে কেন সমর্থন দিয়েছেন তা তো আমি জানি না।’

দলীয় কোনো নেতাকর্মী সাথে না থাকার কারণ জানতে চাইলে মিশন বলেন, ‘এমপি মহোদয়ের নির্দেশনা। উনি ফোনে ফোনে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই আমার সাথে কেউ নেই। তবে সাধারণ জনগণ আমার পক্ষে। দলীয় অনেক নেতা আমার পক্ষে রয়েছেন। কিন্তু ওনারা এমপি মহোদয়ের ভয়ে মুখ খুলছেন না।’ 

এ বিষয়ে জানতে এস এম আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য জানা যায়নি। 

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হালিমা বেগম শান্তার কাছে এমপির সমর্থনের বিষয়ে জানতে চাইলে শুরুতে বিষয়টি স্বীকার করলেও পরে সুর পাল্টে বলেন, ‘সময় কম থাকায় আমরা একসাথে প্রচারণায় যাচ্ছি, অন্য কিছু না।’ আনোয়ার হোসেনের পক্ষে ভোট চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।

নির্বাচনী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা সিভয়েস২৪ কে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা কোনো প্রার্থীর কাছ থেকে কোনো প্রকার অভিযোগ পাইনি। আমরা আশাবাদী যেকোনো ধরনের সংঘাত ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ করতে পারবো। অলমোস্ট বিজিবি চলে এসেছে। ডিবি, এনএসআই, ডিজিএফআই সদস্যরা সন্দ্বীপ অবস্থান করছেন। আর যথেষ্ট পুলিশ ফোর্স পাবো। পাশাপাশি আমরা এবার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটও পাবো।’

প্রসঙ্গত, সন্দ্বীপ উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ভোটকেন্দ্র ৮৬টি। আর ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ৯২৪ জন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়