‘কাজ নেই তো খাবারও নেই’

রবিউল রবি, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১১:১১, ১ মে ২০২৪
‘কাজ নেই তো খাবারও নেই’

ফজরের আজান শুনেই ভাঙে ঘুম। মুখ-হাত ধুয়ে কোনোমতে দুটো মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়েন কোদাল, ঝুড়ি, কড়াই নিয়ে। রোদ, বৃষ্টি কিংবা জলোচ্ছ্বাস—কিছুই আটকাতে পারে না তাদের। সাতসকালে হেঁটেই রওয়ানা হন কাজের সন্ধানে। কাজ পেলেই তবে পেটে জোটে ভাত। তাইতো, অসুখ-বিসুখেও বিশ্রাম নিতে শিখেননি তারা। বছরের ৩৬৫ দিনই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করেন আয়-রোজগার, হোক সেটা পহেলা মে শ্রমিক দিবসেও। 

বুধবার (১ মে) সকাল ৭টার দিকে নগরের চকবাজার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, কাজের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন এমন অর্ধশতাধিক দিনমজুর। এ সময় কথা হয় তাদের সাথে। জানতে চাওয়া হয় মে দিবস নিয়ে। 

দিনমজুর ইউসুফ আলী সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘সব দিনইতো হামদের লাগি সমান। যে ট্যাকা পাই বড় কষ্ট কইরে দিন পাইর কইরে দেই।’ 

ইউসুফ জানালেন, একদিন তিনি টাকা জমিয়ে বাড়ি করবেন। সেখানে থাকবেন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। তার ভাষায়, ‘একদিন আমার সুন্দর বাড়ি হবেক। সেইখানে স্ত্রী-লেইকা-বাচ্ছা লিয়ে থাকমু।’ 

পঞ্চাশোর্ধ আব্দুল বারেক খাঁ, মো. রাকিব, রশিদ খান ও মো. হানিফ ইসলামের সাথে কথা হয় নগরের দেওয়ানহাট মোড়ে।

মে দিবস সম্পর্কে কী জানেন—এমন প্রশ্ন শুনেই বারেক খাঁ গালভর্তি হাসি নিয়ে বললেন, ‘একদিন না খাইয়া থাকলে কেউ খাওয়াইবো? মে দিবস দিয়া কি করমু? এখন দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পাই। একেক সময় একেক রকম। আমাগো ঘরে মানুষ ৬ জন। সব মিলাইয়া এখন জিনিসপত্রের যে দাম, খাইয়া পইড়া আছি এইডাই শুকরিয়া। মে দিবস দিয়া কাম কি?’ 

যত ট্রিপ তত টাকা—

চালক ও চালকের সহকারীদের মাসিক বা দৈনিক বেতন এবং দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল মালিক সমিতি। কিন্তু ট্রিপ অনুযায়ী চালকেরা মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। বেশি ট্রিপ দিতে পারলে টাকা বেশি। ফলে, এই সুযোগ মিস করতে চান না পরিবহন শ্রমিকরা। মে দিবস নিয়ে কিছুই জানেন না, কিন্তু যত ট্রিপ তত টাকা—জানেন এইটুকুই। জিইসি মোড়ে দাঁড়িয়ে ১০ নম্বর রুটের বাস চালক হামিদ মিয়া জানালেন এসব কথা। 

তিনি বলেন, ‘মালিক সমিতি কত সময় কত ওয়াদা যে দেয় মিডিয়ায়। কিন্তু আমরা গাড়ি লইয়া বাইর না অইলে খামু কি? আমরা তো দৈনিক ভিত্তিতেই ট্যাকা পাই। আমরা দিনে ১৬ ঘণ্টাও ট্রিপ মারি। কারণ, ওই যে যত ট্রিপ ততো টাকা।’ 

‘কাম না করলে পেটে ভাত জোটে না’

শ্রমিক দিবসেও দম ফেলার ফুসরত ছিলো না নগরের সদরঘাট এলাকার মাঝিরঘাটের পণ্য খালাস শ্রমিক শফিকুরের। বৈশাখের কড়া রোদ মাথায় তোলা বস্তা ভেদ করে পড়ছিলো পুরো শরীরে, আর ঘামে চকচক করছিলো শরীর। তার শরীরে যেন ঘাম ঝড়ছে কষ্টের কান্না হয়ে।  

কাজের ফাঁকেই বুধবার (১ মে) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় শফিকুরের সাথে। তিনি বলেন, ‘মে দিবস কি হেইডা জানি না। আমগো কোনো বন্ধ নাই। কাম না করলে পেটে ভাত জোটে না। দিবস দিয়া কি অইবো?’ 

খানেক বাদে আরেক শ্রমিক মো. মুসার কাছে মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছুটা বিব্রত আর ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘আপনাগো (সাংবাদিক) এই মে মাসের এক তারিখেই আমগো কথা মনে পড়ে? সারা বছর কেউতো খবর লয় না আমাগো। একদিন অসুস্থ থাকলে খাইতে পারি না। আপনি আইছেন দিবস লইয়া।’ 

শ্রমিক দিবস কী-কেন?

এই দিবসের সূচনা মূলত আজ থেকে ১২৭ বছর আগে আমেরিকান সমাজে। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকায় শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন। অধিকার আদায়ে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা সেদিন পথে নেমেছিলেন। কারণ সেই সময় দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো এক একজন শ্রমিককে। কিন্তু বিনিময়ে পারিশ্রমিক ছিল খুবই সল্প, যা তাদের তাদের জীবনধারণে পর্যাপ্ত ছিল না।  

পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় হঠাৎ পুলিশের ওপর বোমা হামলায় নিহন হন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। নিহত হন প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক। আহত হয়েছিলেন বহু। 

কিন্তু শ্রমিকদের এই বলিদান বিফলে যায়নি। শিকাগো শহরের রক্তাক্ত ইতিহাস সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আলোড়ন তোলে। এ ঘটনার দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ১৮৯১ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। 

সেই থেকে শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা দিনে আট ঘণ্টা করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, এই দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিনে ছুটির কথাও বলা হয়। সেই থেকে আজও মে মাসের প্রথম দিনটিকে (মে ডে) শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। 

এদিকে, আজ মে দিবসে সরকারি ছুটির দিন। এদিন সকাল থেকেই চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়