দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অসহনীয় তাপমাত্রা কেন?

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫:০২, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অসহনীয় তাপমাত্রা কেন?

ভৌগোলিক কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। দেশের উষ্ণতম জেলা রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক চার ডিগ্রিতে উঠলেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এদিকে বরিশালের তাপমাত্রা একটু কম হলেও গরমের অনুভূতি খুবই বেশি। তবে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ জেলা রয়েছে তাপপ্রবাহের বাইরে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের উষ্ণতম জেলা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওপর দিয়ে বর্তমানে মাঝারি থেকে অতি তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক চার ডিগ্রিতে উঠলেও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এপ্রিলের প্রায় পুরোটাজুড়েই চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। সেইসাথে রাজশাহীও এই তালিকায় আছে।

মূলত, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বছরের এই সময়ে চুয়াডাঙ্গা সহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেবরাবরই অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থানেই মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যের কিরণ বা রশ্মি লম্বালম্বিভাবে এসে পড়ে। অল্প কিছু এলাকায় বাঁকাভাবে পড়ে। বিশেষ করে এপ্রিলে সূর্য বাংলাদেশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। এসময় আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশি পরে এই অঞ্চলে।

চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া এবং উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ এলাকার বাতাস উত্তপ্ত থাকার আরেকটি কারণ হল ‘লু হাওয়া’।

চলমান তাপপ্রবাহকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স এন্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান। তার মতে, “তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক, এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এইসময় এটা কম-বেশি প্রতিবছরই হয়। তবে এ বছর বেশি হচ্ছে।”

“এর জন্য জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের তাপমাত্রার সাথে এখনকার তাপমাত্রা তুলনা করলে দেখা যায়, গড়ে পৃথিবির এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। এক ডিগ্রি বাড়াতেই বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাপদাহ, বন্যা, তুষারপাত দেখা যাচ্ছে।”

রাজশাহী, যশোর, চয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বাড়লেও, গরম বেশি অনুভূতি হয় বরিশাল অঞ্চলে। বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, ঐসব অঞ্চলের চেয়ে তাপমাত্রা অনেকটাই কম। কিন্তু বরিশালের তাপমাত্রা যশোর চুয়াডাঙ্গার চেয়ে একটু কম হলেও গরমের অনুভূতি খুবই বেশি।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন,  “উপকূলীয় এলাকায় তাপমাত্রা এমনিতেও ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রির বেশি উঠে না। কিন্তু তাপমাত্রা কম থাকলেও গরমে সেখানে নাভিশ্বাস উঠে যায়। কারণ বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর থাকার কারণে অনবরত বাষ্পায়ন হয়। তাছাড়া, বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় ওখানের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। মূলত, বাতাসে যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন গরমও বেশি অনুভূত হয়।”

তবে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে সহনীয় মাত্রার গরম রয়েছে। ওই তিন বিভাগের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হওয়ার অন্যতম কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। এইসব অঞ্চলে একদিকে যেমন আছে বিস্তীর্ণ হাওর, অপরদিকে আছে সুউচ্চ পাহাড়।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, “ময়মনসিংহ এলাকায় হাওড়ের মতো বিশাল জলাধার আছে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ওখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। তাই তাপমাত্রা কম। চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় গরম কম অনুভূত হওয়ার এটা প্রধান কারণ। আর যদি বনাঞ্চলের হিসেব করি, ওইসব অঞ্চলে বনায়ন বেশি এবং আশেপাশে জলাধার আছে।”

তিনি আরও বলেন, “বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয় বাষ্প বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেটা পাহাড়ি এলাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন ওই জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ঊর্ধ্বগমন ঘটে বা উপরের দিকে যায়। তারপর, ওই বাতাসের ভেতরে যে পানির কণা থাকে, তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘ তৈরির পর তা পাহাড়ের সম্মুখভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও তাপমাত্রা কমায়। তাছাড়া, পাহাড়ি অঞ্চলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, পাহাড়ের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে অন্যদিকে ছায়া পড়ে। আর, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বাতাস প্রবাহিত হয়। দুই পাশের, মানে উত্তপ্ত বাতাস ও ঠাণ্ডা বাতাস মিশ্রিত হয়ে সেখানকার তাপমাত্রা একটু কম রাখে।”

পহেলা মে থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার কিছু এলাকার তাপমাত্রা কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রঝড় ও কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। তখন দুই থেকে ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়