চট্টগ্রাম অতিক্রমকালে যেমন ছিল সিত্রাংয়ের তেজ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২৫ অক্টোবর ২০২২
চট্টগ্রাম অতিক্রমকালে যেমন ছিল সিত্রাংয়ের তেজ

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। দেশের আকাশ থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টার আগেই যার চিহ্ন মুছে গেছে। কিন্তু যাওয়ার আগে ‘সিত্রাং’ রেখে গেছে কিছু প্রশ্ন। বৃষ্টি ঝরিয়ে সময়ের সঙ্গে শক্তি হারিয়েছে বলেই সিত্রাংয়ের ভয়ংকর রুপের মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে অল্পের জন্য হলেও তাণ্ডব দেখিয়েছে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলের বাসিন্দাদের। যার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন— বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ভুল পূর্বাভাসকে। 

পূর্বাভাসে যেমন ছিল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং

গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায় দেওয়া আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ছয়) বলা হয়েছে— বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে পরিণত হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলো থেকে কত কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে তার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি সাথে কত কিলোমিটার দূরে আছে তা উল্লেখ করা থাকে। পরদিন ২৪ অক্টোবর সকাল ৬টায় দেওয়া আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে ২৫ অক্টোবর ভোররাত অথবা সকাল নাগাদ খেপুপাড়ার নিকট দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে। পরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতেও (নয়) বলা হয়েছে ২৫ অক্টোবর মধ্যরাতে অথবা ভোররাতে আঘাত হেনে উপকূল অতিক্রম করবে। 

অথচ বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ২৩ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রায় প্রতিটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ভোরে আঘাত হানবে সিত্রাং। কিন্তু অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে দেওয়া ওই সময়েই বিদায় নিয়েছিল সিত্রাং। সেখানে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানার কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক আপডেট তথ্য জানিয়েছিলেন কানাডার সাচকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ। বলা যায়, আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া পূর্বাভাসে সিত্রাংকে কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর আবহাওয়ার স্থানীয় পূর্বাভাসে ঘূর্ণিঝড়ের পুরো বিষয়টি আরও গুরুত্বহীন ছিল। 

বাস্তবে যেমন ছিল সিত্রাং

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস প্রকাশের আগে থেকেই বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে দাপট দেখাতে শুরু করে ঘর্ণিঝড় সিত্রাং। ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতিতে বাতাসের শক্তি নিয়ে সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝামাঝি এলাকায় উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। রাত ১টা থেকে ৩টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি সিলেট বিভাগ ও ময়মনসিংহ বিভাগের উপর দিয়ে অতিক্রম করে। ভোর ৬টার মধ্যে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, ও ত্রিপুরা রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সিত্রাং। আর সিত্রাংয়ের দাপটে দমকা বাতাসে গাছের চাপায় পড়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, সাপে কাটা এবং নৌকা ডুবিতে ১৪ জেলায় ৩৩ জন নিহত হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। 

এছাড়াও চট্টগ্রামের ৬৬ ইউনিয়নে ৫৮৫৪ ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং চলাকালীন ট্রলার ডুবে, গাছ ভেঙে, দেয়াল ধসে, নৌকা ডুবে আরও ২৫ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে—  ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশনে মারা যান ৪ জন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ৩ জন, টাঙ্গাইলে ৩ জন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ২ জন, সিরাজগঞ্জের ২ জন, পটুয়াখালীতে ১ জন, বরগুনা ১ জন, নোয়াখালী ১ জন, শরীয়তপুরে ১ জন, কক্সবাজারের টেকনাফে ২ জন, গাজীপুরে ১ জন, মুন্সিগঞ্জে ২ জন এবং নড়াইলে ও বরগুনা সদর উপজেলায় একজন করে মারা গেছেন।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টার জেলা-উপজেলার তথ্য সংগ্রহের পর আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর প্রভাবে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মোট ৬৬টি ইউনিয়নের ৫৮ হাজার ৫৭২ জন মানুষ দুর্যোগের কবলে পড়ে। এছাড়া চট্টগ্রামের ৫৮৫৪ ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এরমধ্যে আংশিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ৫ হাজার ৭৬০ এবং সম্পূর্ণ বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৯৪টি।

চট্টগ্রামে যেমন ছিল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব

সিত্রাং বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে দাপট দেখালেও নগরে এর প্রভাব ছিল যতসামান্য। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুসারে, সিত্রাং এর প্রভাবে চট্টগ্রামে দিনভর হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টিপাত হলেও গত ৪৮ ঘন্টায় সর্বমোট ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এরমধ্যে বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়। গতকাল (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা নাগাদ বাতাসের গতিবেগ বাড়তে শুরু করে চট্টগ্রামে। সেসময় ঘন্টায় ৭২ থেকে ৭৪ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ী দমকা হাওয়া আকারে প্রবাহিত হয়। একইসময়ে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ৮ মিলিমিটার। পরবর্তীতে রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ধীরে ধীরে বাতাসের গতিবেগ কমতে শুরু করে। সেসময় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ১২ মিলিমিটার এবং বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৩৮ কিলোমিটার। রাত ৩টায় বৃষ্টিপাত আরও কমে দাঁড়ায় ১ মিলিমিটারে আর বাতাসের গতিবেগ ৩৩ কিলোমিটারে। ভোর ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ১ মিলিমিটার আর সেসময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২৫ কিলোমিটার। তবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং’র প্রভাব বেশি পড়েছে পতেঙ্গা, মোহরা আর হালিশহরের উপকূলীয় এলাকায়। 

সিত্রাং নিয়ে যা বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর

বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর আঘাত হানার বিষয়ে পূর্বাভাসে আগে-পরে হওয়া তথ্যের প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক সিভয়েসকে বলেন, ‘শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড়ের যে মুভমেন্ট ছিল পরে সেটা অনেক দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে স্পিড কমে গিয়ে মুভমেন্ট স্পিড বেড়ে যায়। যার কারণে দ্রুতই উপকূলের দিকে এগিয়ে যায়। পরে কিন্তু আমরা বুলেটিনে কারেকশন করে দিয়েছিলাম। মূলত ঘূর্ণিঝড়টির গতিবিধি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। যার কারণে একটু এদিক সেদিক হয়েছে।’

কানাডার সাচকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশের দেওয়া পূর্বাভাস সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এরকম আপডেট আমরাও দিতে পারি। কিন্তু ১৫ দিন আগে বলে তো মানুষকে বিভ্রান্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা মোটামুটি শিউর না হয়ে তো বলতে পারি না যে ঘূর্ণিঝড় হবে আমরা সিগন্যাল দিবো। আর বেশি আগে বললে ত্রুটি বেশি থাকবে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। উনি (আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ) বলেছিলেন ২০ তারিখের দিকে সিডরের মতো একটা সাইক্লোন হবে। কিন্তু তা তো হলো না। শুধু শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করে কি লাভ? দেখা যাবে পরে সিগন্যাল দিলে মানুষ মানবে না।’

-সিভয়েস/এসআর

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়