Cvoice24.com

‘অনন্তকালের নিদ্রায় শায়িত থাকবে বন্ধু তুমি পবিত্র মাটিতে’

মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
‘অনন্তকালের নিদ্রায় শায়িত থাকবে বন্ধু তুমি পবিত্র মাটিতে’

দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি আর মোছলেম উদ্দিন এই চট্টগ্রাম শহরে একই সঙ্গে রাজনীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছি সহকর্মী-বন্ধুর মতো। আমার বাড়ি দামপাড়ায়; তাঁর বাড়ি রাস্তার ওইপাড়েই লালখান বাজার এলাকায়। আমরা দুজনেই স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার (বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচন কমিশনার নির্বাচিত হই; আমি বাগমনিরাম ওয়ার্ড থেকে আর তিনি লালখান বাজার ওয়ার্ড থেকে। দলীয় সহকর্মীর সম্পর্কটি দীর্ঘ ৫ দশকের পরিক্রমায় আমাদের পারিবারিক সম্পর্কে পৌঁছেছে। আমার বড় ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ ও সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন এজিএস শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ছোট বেলার সাথী ছিলেন মোছলেম উদ্দিন।

সেই সূত্রে আমাদের বাড়িতে তিনি নিয়মিত আসতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে গণ-জাগরণের উত্তাল দিনে তিনিসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের আনাগোনায় আমাদের বাড়ি মুখরিত থাকতো। ১৯৭০ দশকের শুরুতেই বাঙ্গালী জাতি বুঝতে পেরেছিল— পাকিস্তানিদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে হলে সংগ্রামের বিকল্প নাই। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রামে থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেসময় থেকেই একজন মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর সন্তান হিসেবে ছাত্রনেতা মোছলেম উদ্দিন দেশের জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন।

দেশ মাতৃকার বীর সন্তান মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রামের কাজীর দেউরি নেভাল এভিনিউতে পাকিস্তানি নৌ-সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রামের বীর সন্তান মরহুম এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ. ইউনুসসহ। তারা মূলত যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বিছিন্নভাবে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি ও বাঙ্গালী যুবকদের উদ্বুদ্ধ, প্রশিক্ষণে কাজ করছিলেন। ধরা পরার পর নিশ্চিত মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় ময়লার গাড়ির থেকে শরীরে ময়লা মাখিয়ে পাগলের অভিনয় করে মোছলেম উদ্দিন ও মহিউদ্দিন চৌধুরী জেল থেকে বের হয়ে যান। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচেও মোছলেম উদ্দিন নিরাপদে না থেকে পুনরায় সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।

মোছলেম উদ্দিন একজন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক কর্মী। স্কুল জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দেশ, দলের জন্য দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক; পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন বন্ধু মোছলেম উদ্দিন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মরহুম মৌলভী সৈয়দ, মরহুম আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, মরহুম এম এ মান্নান, মরহুম এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের এই কৃতি সন্তান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে অনেকবার কারাবরণ, জুলুম, নির্যাতনের শিকার হন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রায় ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। মহান আল্লাহ তার মনের আশা শেষ সময়ে পূর্ণ করেন। গত কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও সুযোগ পেয়ে যান। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ হারিয়েছে এক দেশপ্রেমিক সন্তান, আদর্শবান রাজনীতিবিদকে।

মোছলেম উদ্দিন কখনও প্রিয় মাতৃভূমি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করেন নাই। তার মৃত্যুর পর প্রতিটি মুহূর্ত আমার কেটেছে পুরোনো দিনের সংগ্রামী স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে। অপেক্ষায় ছিলাম কখন ঢাকা থেকে তাঁর মরদেহ আসবে প্রিয় চট্টগ্রামে। বোয়ালখালীতে প্রথম জানাজার পর তার দ্বিতীয় জানাজা হল আমার বাড়ির পাশে দামপাড়া জামায়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠে। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখে অভিভুত হলাম।

সাধারণত জানাজার পর বাসায় চলে যাওয়ার কথা থাকলেও মন মানছিল না। ইচ্ছে করছিল না বন্ধুকে বিদায় দিতে। তাই তার শবদেহবাহী (প্রাণহীন শরীর) গাড়ির সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনকে নিয়ে ছুটে চললাম তার চির নিদ্রার শেষ ঠিকানা হযরত গরীব উল্লাহ্‌ শাহ (রা.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই তাকে মাটি দেওয়া হল। আমরা সবাই তার কবরে ফাতেহা পাঠ, ফুলেল সম্মান জানালাম।

‘অনন্তকালের নিদ্রায় শায়িত থাকবে বন্ধু তুমি এই পবিত্র মাটিতে; যে মাটিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তুমি করেছ বীরের মতো লড়াই। আর তো বন্ধু থাকার সুযোগ নাই; এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা।’ বিদায় বেলায় বলবো— ‘বন্ধু আজ যদিও শেষ দেখা হল, তবুও বলবো না চির বিদায়। এ দেশ, মাটি তোমাকে অনন্তকাল মনে রাখবে। এ জাতি তোমার কাছে ঋণী।’

মরহুম জননেতা মোসলেম উদ্দিনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়