বিএনপির কর্মসূচিতে সহিংসতা: কী বলবেন হাস?
ধ্রুব হাসান
২৮ অক্টোবর নিয়ে দেশবাসীর শঙ্কা-আতঙ্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই সত্যি হলো। বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় পুড়ে ছাই হলো বহু যানবান। হামলা হলো প্রধান বিচারপতির বাসভবন, সরকারি অফিস, পুলিশ হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পিটিয়ে হত্যা করা হলো পুলিশ সদস্যকে। বাসে আগুন দিয়ে খুন করা হলো হেলপারকে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ডেকে বিএনপি সহিংসতার পথে গেলে অথচ এনিয়ে যক্তিরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কোনো উচ্চবাক্য নেই। ঘটনার নিন্দাও জানান নি। অথচ বিএনপি-জামায়াতের বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়ে মায়া কান্না জুড়ে দেন পিটার হাস।
অথচ গত ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, জানতে চেয়েছিলেন পিটার হাস। এরপর বিষয়টি অস্বীকার করে রাতে দিকে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র এক বার্তায় জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ঢাকার রাস্তাঘাট বন্ধের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। এরআগে ১২ অক্টোবর পিটার হাসের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক হয়। যদিও ঢাকার গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে ওই বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তাদের এমন অস্বীকার করার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও এমন বেফাঁস মন্তব্য করে পরে তা অস্বীকার করেছে মার্কিন দূতাবাস। কথা ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া তাদের বহু পুরনো কৌশল। পিটার হাস বড় বিতর্কের জন্ম দেন ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সাবেক ছাত্রদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের রাজধানীর শাহীনবাগের বাসায় যান। অথচ তিনি ওইদিন বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাননি। সেদিন বড় বিতর্কের জন্ম দেন, ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা তাদের দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি দিতে গেলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাদের কথা না শুনে এড়িয়ে যান।
পিটার হাসের এ আচরণকে বিশিষ্টজনেরা কূটনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূত আচরণ হিসেবে দেখছেন, যা কিনা ভিয়েনা কনভেনশনের ( ১৯৬১) পরিপন্থী। একই সঙ্গে তার এ ধরনের আচরণ কূটনৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা, নাকি এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়লেন এবং বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষভুক্ত হলেন কিনা, এ নিয়ে দেশের জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওই বিষয়ে উদ্বেগ জানায় আরেক পরাশক্তি রাশিয়া। শাহীনবাগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকের পরিবারের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দেখা করতে যাওয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করে রাশিয়া। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, 'শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সফরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করে রাশিয়া।'
শাহীন বাগের ঘটনার পর পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে মার্কিন দূতাবাস। সেদিনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও। অথচ সেদিন হাসের সেই কর্মসূচির বিষয়ে আগে থেকে পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছুই জানানো হয়নি। এরপর মে মাসে বাংলাদেশ সকল রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেয়। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্বের কোনো দেশেই রাষ্ট্রদূতদের এমন ভিআইপি প্রটোকল দেওয়া হয়না। এরপরই অসন্তোষ জানায় মার্কিন দূতাবাস।
পিটার হাস নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির পতাকা নামিয়ে চলাফেরা করতে থাকেন। এটিও কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত কাজ। অথচ দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিজ খরচে বাংলাদেশ প্রদান করে থাকে। শুধুমাত্র পরিস্থিতি বিবেচনায় দেওয়া সড়কে চলাচলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয় সে সময়।
গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। মামলাটির তদন্তে সার্বক্ষণিক নজর থাকবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয় পরিদর্শন করে পিটার হাস এসব কথা বলেন। এভাবে দেশের প্রতিটি বিষয়ে মন্তব্য করে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন হাস।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নতুন করে ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এ নিয়ে প্রচুর জল ঘোলা করতে থাকে বিরোধীদল ও মার্কিন দূতাবাস। এরমধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্য দিতে থাকেন হাস। এক পর্যায়ে তিনি ভিসানীতিতে গণমাধ্যমকে আওতায় আনার বিষয়টি উল্লেখ করেন। অথচ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো ভিসানীতি ও এর পরবর্তী কোনো বক্তব্যেই গণমাধ্যমকে জড়ানোর কোনো কথা উল্লেখ ছিলো না। অথচ তিনি ভিসানীতিতে গণমাধ্যমকেও জড়ানোর কথা বলেন। এ নিয়ে আবার সম্পাদকদের ডেকে এর ব্যাখ্যাও দেন। এ যেন যখন যা খুশি করার মতো বিষয়। একটা কথা বলে দিলেন, এরপর বিতর্ক হলে সে নিয়ে ঘুরিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিয়ে দিলেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কারের পর এ নিয়েও বিতর্ক আর হুমকি দেন পিটার হাস। পিটার হাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডেটা সুরক্ষা আইন যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে ‘বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতা ও ব্যবসায় বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ যেন মামার বাড়ির আবদার। দেশে ব্যবসা করবেন অথচ দেশের আইন মানবেন না। আইন লঙ্ঘন করে ফৌজদারি অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না!
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের নিজস্ব স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি আছে। অথচ বাংলাদেশের সাথে চীনের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বকে নিয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেন পিটার হাস। চীনের নিয়ন্ত্রণহীন প্রভাব ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ও কৌশলগত স্বায়ত্ত শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ আর ঋণের বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন তিনি ও তার দূতাবাস। এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস ও বেইজিং এর পররাষ্ট্র দপ্তর। বাংলদেশকে নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরিতে ভূমিকা পালন করছেন এই হাস সাহেব।
প্রতিনিয়ত কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার লঙ্ঘন করে অনিয়ন্ত্রিত চলা ফেরা করেন মার্কিন দূতরা। পিটার হাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এরপর নিরাপত্তা ঘাটতির ধুয়া তুলতে থাকেন।
পিটার ডি হাস একজন রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশে এরকম বহু দেশের রাষ্ট্রদূত রয়েছেন। রাষ্ট্রদূতদের কাজ হল তার দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে থাকা। বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা, এ দেশের অর্থনীতি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুইদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন করা। কিন্তু তারা বাংলাদেশে এসে যেন এ দেশের অঘোষিত কর্তায় পরিণত হয়েছিলেন। সরকার এবং প্রশাসন সবকিছুকেই তাদের নিজস্ব অনুগত বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। পিটার ডি হাস ভাইসরয়ের মতই হিতোপদেশ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কি চায় তা নতুন করে নসিহত করেন। কিন্তু বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে ২৮ অক্টোবর যে সহিংসতার পথ বেছে নিলে সে বিষয়ে কী বলছেন পিটার হাস?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।