বাংলার চৈত্র সংক্রান্তি আদ্যোপান্ত

স্বর্ণা নন্দী

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ১২ এপ্রিল ২০২৪
বাংলার চৈত্র সংক্রান্তি আদ্যোপান্ত

বাংলা বছরের শেষের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনকে বলা হয়ে থাকে চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তিতে আমাদের বাংলার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি উঠে আসে। একসময় বাংলার প্রতিটি ঋতু জুড়েই থাকতো সংক্রান্তি। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সব। তবে বাঙালি এখনো দুইটি সংক্রান্তি পালন করে আসছে  পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তি।

চৈত্র সংক্রান্তির আদ্যোপান্ত

চৈত্র থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ থাকতো। সূর্যের সেই তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবীরা চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতেন। সনাতন শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়।

লোক সমাজে প্রচলিত আছে, তিক্রা নক্ষত্র হতে এমাসের নাম করণ করা হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত আছে, সাতাশটি নক্ষত্রের নামে দক্ষ রাজ সুন্দরী কন্যাদের নামকরণ করেছিলেন। তার দু'কন্যার নাম যথাক্রমে চিত্রা ও বিশাখা। এক মাস ব্যবধানে জন্ম বলে এই দুই কন্যার নাম থেকে জন্ম নিল বাংলা দুই মাস; যথাক্রমে চৈত্র ও বৈশাখ।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পুজোর চল আছে চৈত্র  সংক্রান্তি ঘিরে। তারমধ্যে অন্যতম হলো, চড়ক পূজা, শিবা পূজা বা নীল পূজা। 

সংক্রান্তির দিন শিবের গাজন বা চড়ক পূজা, আর তার আগের দিন নীল পূজা। সেও শিবেরই পূজা। সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত বিষ কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ, তাই নীল পূজা। সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়েরা নীলের উপোস করে। "আমার বাছার কল্যাণ করো হে নীলকণ্ঠ, সব বিষ কণ্ঠে নিয়ে তাকে অমৃত দাও"। শিব নীলকণ্ঠ জগতের সব বিষ পান করেও সত্য সুন্দর মঙ্গলময়। পুজো শেষে খেজুর খেয়ে ভক্তরা উপোস ভাঙেন।

উল্লেখ্য উত্তরাঞ্চলের মানুষ চৈত্রসংক্রান্তির গোধূলি লগ্নে বেসমা পূজা করত। পূজার সময় ঘরের দরজায় বাগাচূড়া (চ্যাপ্টা পাতা ও কাঁটাযুক্ত বনজ লতা), বিষ ঢেঁকিয়া (ফার্ন), বিষ কুণ্ডলী (বিষকাঁটালী), রসুন, পেঁয়াজ একসঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এগুলো অশুভ শক্তিনাশের প্রতীক বলে বিশ্বাস করে এই অঞ্চলের মানুষ।

চড়ক গাজন বা চড়ক পূজা

চৈত্র সংক্রান্তির মূল আকর্ষণ হলো এই চড়ক গাজন। এক গ্ৰামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য গ্ৰামের শিবতলায় নিয়ে যাওয়া। একজন শিব‌‌ ও একজন গৌরি সেজে নৃত্য করে এবং অন্যরা নন্দি, ভৃঙ্গি , দৈত্য দানব আরো বিভিন্ন রকমের সাজে সেজে এক সাথে নৃত্য করে। 

চৈত্র সংক্রান্তি মেলা

বাংলার প্রতিটি গ্ৰামেই মূলতো চৈত্রের শেষে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় গান বাজনা, নৃত্য, যাত্রাপালা সহ বিভিন্ন সংস্কৃতি আয়োজন করা হয়ে থাকে। বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলা, ঘুড়ি উড়ানোর, বায়োস্কোপ ইত্যাদি  আয়োজন থাকে। নতুন রূপে সেজে উঠে বাংলার গ্ৰাম। এসময় প্রতিটি গ্ৰামবাসীর ঘরে আনন্দে জোয়ার বয়ে যায়।  গৃহস্থরা তাদের নাতি-পুঁতি, মেয়ে জামাই আত্মীয়-স্বজনদের নতুন জামাকাপড় দিয়ে থাকে। সাথে থাকে খাবারের বিশাল আয়োজন। 

এভাবে যুগ যুগ ধরে গ্ৰাম বাংলায় পালিত হয়ে আসছে চৈত্র সংক্রান্তি। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রায় সবকিছু হারিয়ে যেতে বসেছে।

লেখক: সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম যোগাযোগ বিভাগ। 
গ্রিন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়