৩৩ বছরেও থামেনি স্বজনহারার কান্না

মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, বাঁশখালী 

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
৩৩ বছরেও থামেনি স্বজনহারার কান্না

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হন। ক্ষতি হয় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রায় এক লক্ষ মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ।

নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ৯১-এর এই ঘূর্ণিঝড় একটি। উপকূলবাসীকে এখনো সেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘটনার এত বছর পরও স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না সেই দুঃসহ দিনটি। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে হলে। নিহতদের লাশ, স্বজন হারানোদের আর্তচিৎকার আর বিলাপ বার বার ফিরে আসে তাদের জীবনে। 

ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ফুঁসে ওঠা সমুদ্রের ২৫ ফুট উঁচু তীব্র জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ উপকূলীয় বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপসহ কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলা। এই ঝড় এতো প্রলয়ঙ্করী ছিল যে, বাতাসের তোড়ে গায়ের জামা পর্যন্ত খসিয়ে নিয়ে যায়।

সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে বয়ে যাওয়া ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বিরাণভূমিতে পরিণত হয় উপকূল।  এর সাথে মারাত্মক জলোচ্ছাস লণ্ডভণ্ড করে দেয় বাঁশখালী উপজেলাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা। হাজার হাজার মানুষ সহ ৭৫-৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি, অসংখ্য গবাদি পশু ও গাছপালা ধ্বংস হয়। গাছের ডালে, ঘরের চালে, খাল-বিলে, নদীতে ও সাগরে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে প্রচুর ধনসম্পদ ভেসে যায়। 

ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চট্টগ্রাম জেলার  উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালী। শুধু বাঁশখালীতেই সেদিন ৪৫ হাজার মানুষ নিহত এবং কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেদিন এদেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে অবলোকন করেছে প্রকৃতির অমানবিক তাণ্ডব। সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি উপকূলীয় বাঁশখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষের। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধশ্বাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ আর কখনো হয়নি। সেই দিনের স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বেঁছে আছে উপকূলের মানুষ।

ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা আমিরুল কবির ইমরুল বলেন, তখন আমরা স্কুলে পড়তাম। আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন বাড়িতে গিয়ে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। মৃত গবাদি পশু যেখানে সেখানে পড়ে ছিল। গাছের উপরে আটকে আছে বাড়ির চালা। 

গণ্ডামারা এলাকার সরওয়ার আলম সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন লাশের স্তূপ জমে গিয়েছিল। শুধু মানুষ নয়, গরু-ছাগল-মহিষ আর মানুষের মৃতদেহে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কোনও রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মানুষ ও পশু মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল।

উপকূলীয় ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ মুহিবুল্লাহ ছানুবী বলেন, ১৯৯১ সালের এইদিনে আমার বাবাসহ আমাদের পরিবারের ১৫-২০ জন সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন সদস্যের লাশ পেয়েছিলাম, অন্যান্য সদস্যের লাশ ২৮ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি।তা দের সেই দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে ৩৩ বছর ধরে কেঁদে যাচ্ছি। সাগর পানে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছি।  প্রতি বছর ২৯শে এপ্রিল এলেই বাড়ীতে কান্নার রোল পড়ে যায়। কাউকে শান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে মহান আল্লাহ তুমি তাদের ধৈর্য শক্তি দাও।

প্রায় ৩৮ কিলোমিটার সাগরবেষ্টিত বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা একটি মাত্র বেড়িবাঁধের অভাবে আজও অরক্ষিত। অবশ্য বর্তমান সরকার উপকূলবাসীকে রক্ষার্থে ২৫১ কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধকে আধুনিক বেড়িবাঁধে পরিণত করার কার্যক্রম হাতে নিলেও ঠিকাদারদের নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খুবই ধীর গতিতে চলছে উন্নয়ন কাজ। 

উপকূলীয় জনগণের অভিযোগ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে যথেষ্ট অনিয়ম পরিলক্ষিত হলেও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। অথচ উপকূলবাসীর জীবন-মরণ বাঁধ খ্যাত এ বেড়িবাধটি অরক্ষিত থাকায় বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী ৫ লক্ষাধিক মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ছনুয়া, বড়ঘোনা, গণ্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, ইলশা, পুকুরিয়া, সাধনপুর ও প্রেমাশিয়াসহ বাঁশখালীর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ প্রতি বর্ষায় আরো একটি ২৯ এপ্রিলের ছোবল আতঙ্কে  থাকেন। 

প্রতিবছর এই দিনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উপকূলবাসীর মাঝে। বিশেষ করে খানখানাবাদ, কদমরসুল, ছনুয়া, বড়ঘোনা, গণ্ডামারা ও প্রেমাশিয়া এলাকায় প্রতি বর্ষায় সামুদ্রিক লবণ পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় হাজার হাজার মানুষকে পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনাযাপন করতে হয়।

এখন উপকূলবাসীর একটাই দাবি, এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, সাইক্লোন সেল্টার ও আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন, বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সাইক্লোন সেল্টারগুলো দখলমুক্ত করণ এবং উপকূলীয় এলাকার রাস্তাঘাটের সংস্কারের মাধ্যমে বাঁশখালী উপকূলীয় জনগণের চাহিদা পূরণে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁশখালী উপকূলবাসীর জীবন রক্ষায় নবনির্মিত ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার স্থায়ী বেড়িবাঁধ জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই ভাঙছে আর ভাঙছে। খানখানাবাদ উপকূলের কদম রসুল গ্রামে বেড়িবাঁধ জোয়ার-ভাটার স্রোতে প্রতিদিনই ভাঙ্গনের খেলায় এখন বিশালকার রূপ নিচ্ছে। কোথাও আবার বাঁধ ধসে গেছে ভয়ানকভাবে। একই দৃশ্য খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদ গ্রাম, পুকুরিয়ার তেইচ্ছিপাড়া, সাধনপুরের রাতা খোর্দ, গণ্ডামারার বড়ঘোনায়, শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখের অদূরে, ছনুয়ার ছোট ছনুয়া। 

উল্লেখিত স্থানগুলোর অন্তত ২৬ স্থানে নবনির্মিত বেড়িবাঁধে সিসি ব্লকে ধস দেখা দিয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রীতে নির্মিত সিসি ব্লকের সিমেন্ট উঠে গিয়ে সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। 

স্থানীয়রা অভিযোগ তুলেছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে লুটপাটের কারণে অল্প সময়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধে ফাটল ধরেছে এবং ভাঙছে। যার ফলে কোটি টাকার বেড়িবাঁধ এখনো অধরা, স্বপ্নের মতোই।

এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে দুর্নীতি করেছেন এ বাঁধ নির্মাণে। বেড়িবাঁধ রক্ষায় ঢালু বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা লাগানো হয়নি। ব্লক নির্মাণে নিম্নমানের পাথর, ইট, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহার করায় কাজ বুঝিয়ে দেয়ার আগেই অধিকাংশ সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধজুড়ে ভাঙা সিসি ব্লক দৃশ্যমান ও নিম্নমানের বেড়িবাঁধ দৃশ্যমান হলেও পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোন নজর নেই।

পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, বাঁশখালী উপকূলের বেড়িবাঁধের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। বেড়িবাঁধের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে তা আগামী বর্ষার আগে পাবার সম্ভাবনা নেই। আমরা দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বক্ষণিক বাঁশখালীকে নজরে রেখেছি।

এদিকে ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্মরণে বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা খানখানাবাদ, সরল, গণ্ডামারা, ছনুয়া ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা, সেমিনার, খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়