সিডিএ-চসিক সমন্বয়হীনতা আর নয়

দেবাশীষ চক্রবর্তী, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
সিডিএ-চসিক সমন্বয়হীনতা আর নয়

অন্ধের মতো যত্রতত্র উন্নয়নের মাধ্যমে নগরের ঐতিহ্য ধ্বংস করার চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ। তার মতে, এমন উন্নয়ন চট্টগ্রামকে সাধারণ মানুষের বসবাস অযোগ্য করে ফেলবে।

চটগ্রামকে ঘিরে প্রাথমিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মুঠোফোনে সিভয়েস২৪-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এ কথা বলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘চট্টগ্রাম পাহাড় ও সমুদ্রে ঘেরা প্রাচীন শহর। এই শহরের প্রতিটি অলিগলি, রাস্তাঘাট ঘুরে আমার বেড়ে ওঠা। নগর রাজনীতির সঙ্গে আমরা সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। তাই নগরের প্রতি আমার দায়িত্বের পাশাপাশি আবেগ সবসময় কাজ করে। সেজন্য অন্ধের মতো যত্রতত্র উন্নয়ন করে নগরের ঐতিহ্য নষ্ট করা এবং সাধারণ মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য করার ইচ্ছে আমার নেই।’

চট্টগ্রামকে ঘিরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী ৫০ বছরের কথা চিন্তা করেই সকল পরিকল্পনা সাজানো হবে। সেখানে অবশ্যই পরিবেশ ও জলবায়ু প্রাধান্য পাবে। পরিবেশকে নষ্ট করে নগর উন্নয়ন কখনো করা হবে না।'

সিডিএতে মোহাম্মদ ইউনুছের প্রথম দিন—

নানা ‘জলঘোলার’ পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। গত ২৪ এপ্রিল আগামী তিন বছরের জন্য তাঁকে এ পদে নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পাঁচ দিন পর সোমবার নিজ কার্যালয়ে যান সিডিএর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ।

প্রথম দিনই ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল ৯টায় সিডিএ ভবনে প্রবেশ করেন তিনি। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন,  ‘প্রথমদিন কেটেছে সিডিএর প্রতিটি বিভাগীয় ও শাখা অফিস ঘুরে। এরপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। পরে বোর্ড মেম্বারদের সাথে প্রাথমিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়।’

চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ইউনুছ বলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন ঘিরে আমার নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা আছে। তবে এখনো পেশ করার সময় হয়নি। এর আগে, সিডিএর প্রতিটি চলমান প্রকল্প সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয় জানতে হবে। তবে পরিকল্পনা পেশ করার আগে নগর পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞসহ সচেতন মহলের সাথে আলোচনা করে সবার মতামত নেওয়া হবে। এরপর আগামী ৫০ বছর পর চট্টগ্রাম শহর কেমন হতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা করবো।’

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘বছরের পর বছর বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা সমস্যায় ভোগেন নগরবাসী। নগরের নিচু এলাকার মানুষ সব থেকে বেশি ভোগান্তির স্বীকার হয়। তবে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হবে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। চলমান প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করা হবে। এছাড়া প্রতিটা প্রকল্প সরেজমিনে নিজ পায়ে হেঁটে দেখবো।’ 

অতীতে বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কাজে সমন্বয়হীনতার অভিযোগের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘অতীতে যেমন হয়েছে এখন আর তা হবে না। চসিক মেয়র আমার পরম বন্ধু। আমরা দুই ভাই একসময় রাজপথে সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। আমরা দুজন পাশাপাশি থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করবো।’                

প্ল্যান বহির্ভূত ভবন নিয়ে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে জানিয়ে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘যেখানে সেখানে প্ল্যান বহির্ভূত ভবন নির্মাণ করা হলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামীতে এসব ক্ষেত্রে আমার অবস্থান হবে কঠোর। তাছাড়া এখন তাপপ্রবাহে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। আগামী দিনের পরিকল্পনার মধ্যে চট্টগ্রামে একটি কৃত্রিম বনায়নকে প্রধান্য দেওয়া হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে নতুন নতুন পন্থা বের করার চেষ্টা করা হবে।’

উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে সরকারের যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার এই পদে চুক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক নিয়োগ দিয়ে আসছে সরকার। সবার প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও বর্তমানে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের সংসদ সদস্য আবদুচ ছালাম ছিলেন চেয়ারম্যান হিসেবে। টানা ১০ বছর চেয়ারম্যান থাকার পর ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল নিয়োগ দেওয়া হয় নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষকে। গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ ছিল। ওই দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে আগামী তিন বছরের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ছাত্রলীগের স্কুল সভাপতি থেকে নগর সভাপতি পর্যন্ত ছিলেন মোহাম্মদ ইউনুছ। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক সিটি মেয়র আজম নাছির উদ্দীন।

এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দুবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালে আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ ১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিকম পাস করেন। তিনি হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ীর মরহুম নুর হোসেনের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা। বর্তমানে চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম ‘৭৫ এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইউনুছ। ২০২৩ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ইউনুছকে জাতীয় পরিষদের সদস্য করে।

এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প সমন্বয় পরিষদ-১ এর আজীবন সদস্য হিসেবে দায়িত্বে আছেন।

আরও পড়ুন—

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়