Cvoice24.com

পদক-কাণ্ড : কোন পথে হাঁটছে চসিক

লিখেছেন : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
পদক-কাণ্ড : কোন পথে হাঁটছে চসিক

প্রিয় মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী,

আপনার অজানা থাকার কথা নয়। অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদ কেমন মানুষ ছিলেন, তাঁর দর্শন, রাজনীতির ভাষাও আপনার বুঝার কথা। প্রথাবিরোধী রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট তিনি। শিক্ষাবিদ সমাজহিতৈষী এই অধ্যাপক ছিলেন এমএনএ। চট্টগ্রাম সিটি কলেজসহ (বর্তমান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) বহু প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ঘটে তাঁর হাত ধরে। সমাজ ও জনমানুষের জন্য তাঁর অবদান আপনার মত একজন লেখক, পাঠক ও অনুসন্ধিৎসু মেয়রের না জানার বিষয় নয়!

আসহাব উদ্দিন আহমেদ এমনই একজন, যিনি শুধু লেখক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম ল্যান্ডমার্ক যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও নির্লোভ ছিলেন। কৃষিকাজ করেছেন। বামধারার এই নেতাকে তাঁর আত্মগোপন-পর্বে কৃষকরাই নিজেদের ঘরে লুকিয়ে রাখতেন। তিনি তাঁর লেখায় কৃষকদের জীবনবোধকে মুখ্য করে তুলেছেন জাতীয় সীমায়।

মহান ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে উত্তুঙ্গু সময়ে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমেদ গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) এই শীর্ষ নেতা হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্তজন। ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু যখন মন্ত্রিত্ব পেয়েও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে তা ছেড়ে দেন, তখনো এই অধ্যাপক ছিলেন ভাষাসংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ।

’৬৬ এর ৬ দফার জন্য তিনি কাজ করেছেন। কাগমারি সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরে এসে সাংগঠনিক বিভক্তির কারণে কলামিস্ট হিসেবে তিনি কখনো কখনো হয়তো বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাও করেছেন।

কৃতী মানুষটির সব ইতিবাচক কাজ প্রশ্নবিদ্ধ করলো সিটি কর্পোরেশন!

আপনাকে জানানো-শেখানো বা জ্ঞান দেওয়ার জন্য এই বর্ণনা নয়।  নতুন প্রজন্মের জানার স্বার্থেই এই অল্প উপস্থাপন। তবে আমাকে অবাক হতে হলো, এই ভিন্নমত বা বিরোধিতার কারণেই চট্টগ্রামের এই কৃতী মানুষটির সকল ইতিবাচক কাজকে কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ করলো সিটি কর্পোরেশন! অথচ বঙ্গবন্ধু নিজেও ভিন্নমত লালনকারীদের পাশে থাকতেন। তাঁদের প্রতি কোনো অবিচার করেননি।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর অগ্রজ নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন তাঁর হাত দিয়েও বেগবান হওয়ার আশা করেছিলেন অনেকে।  কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে দূরদর্শিতার মধ্য দিয়ে ’৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিলেন, তখন ভাসানী ও তাঁর অনুসারীরা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ’

ভাসানীর দর্শনকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ’৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জনরায় প্রাপ্তির মাধ্যমে একাত্তরের জনযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে জানবাজি রেখে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন বঙ্গবন্ধু। অথচ স্বাধীনতার পরেও বঙ্গবন্ধু সেই ভাসানীর কাছে গেলেন।  ভাসানীকে বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে কার্পণ্য দেখেনি জাতি। প্রগতিশীল রাজনীতিতে এভাবে অসংখ্য উদাহরণ টেনে ভিন্নমতের প্রতি সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা কিংবা ভিন্নমতের মানুষগুলোর প্রতি মমত্ববোধের অনেক উদাহরণ বঙ্গবন্ধুকন্যার ক্ষেত্রেও দেখানো যেতে পারে।

যেমন, রাতদিন আওয়ামী লীগকে শূলে চড়াতে চাওয়া, কথায়-বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকে বেশরম সমালোচনা করা মুসলিম লীগারের সন্তান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা করিয়েছেন। বিএনপিপন্থী কিংবা সরকারবিরোধী অনেক সাংবাদিক লেখক, কলামিস্ট, সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিল্পীকে অকাতরে জাতীয় স্বীকৃতি এবং অনুদান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এক্ষেত্রে আমরা কি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার থেকে কিছু শিখতে পেরেছি ...।

বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ না করে চসিক করলোটা কী

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) একুশে স্মারক সম্মাননা ২০২৪ প্রদানের জন্য 'ভাষা সংগ্রামে অবদানের জন্য' অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদের নাম মনোনীত হয়েছিল। প্রয়াত আসহাব উদ্দীনের পরিবার যেঁচে এই পদক চাইতে আসেননি। তাঁরা এটা নিয়ে আগ্রহীও ছিলেন না। মরণোত্তর এই পদকপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা তাঁর পরিবারের কারোরই ছিল না। তাছাড়া ২০০৫ সালে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক পাওয়া এই ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-চসিক ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরে কি পদক দিল বা দিল না, তাতে তাঁর পরিবারের কারো কিছু যায় আসে না।

লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা ও শ্রদ্ধার্ঘ নিয়ে বাঁশখালীতে কলেজের পাশে কবরে শুয়ে থাকা এই মহামনীষীর আর নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই। বরং কোনো কারণ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে 'আবালদের' স্ট্যাটাস দেখে রাতারাতি তাঁকে এই একুশে বইমেলায় পদক না দেওয়ার সিদ্ধান্তটিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন চট্টগ্রামের সর্বজনীন অমর একুশে বইমেলা, আয়োজক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং মেয়র হিসেবে আপনি নিজেই।

গোপনে আপত্তিদাতা ওঁরা কারা?

জনশ্রুতি আছে, কারো কারো গোপন আপত্তির মুখে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীনকে এই পদক প্রদান প্রক্রিয়াটি স্থগিত করা হয়েছে। চসিকের এক কর্মকর্তাসহ একাধিক সূত্রে যা জেনেছি,  তাতে তারা দাবি করছেন, ‘একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সেই নামটি নিয়ে নাকি আপত্তি দেয়া হয়েছে।’

তাদের এমন দাবিটি আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হয়েছে। এদেশে গোয়েন্দা সংস্থার নাম ভাঙিয়ে অনেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। ফলে সহজেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা যায়। প্রশাসনের প্রতি এই উপমহাদেশের মানুষের স্বভাবজাত নেতিবাচকতা রয়েছে। এই সুযোগটা লুফে নিতে চান অকর্মণ্য নপুংশক সুবিধাভোগী শ্রেণী।

আর যদি কোনো বিশেষ সংস্থার কেউ এমন কাণ্ড করে থাকেন তাহলে তার নামটা একজন সাংবাদিক, লেখক ও নাগরিক সংগঠক হিসেবে আমার বেশ জানতে ইচ্ছে করছে। অবাদ তথ্য ও সত্য জানার অধিকার থেকে আশা করি আমাদের বঞ্চিত করবেন না। সেই নামটি জানতে পারলেই বুঝতে পারব, প্রশাসনের কোন কাতারে এখনো বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাবিরোধী শক্তি গদিনশীন আছেন। আমি বিশ্বাস করি, সেই নামটি শুধু আমার নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও জানবার বেশ প্রয়োজন।

এই 'পদক-কাণ্ড' নিয়ে নানা মুনির নানা মতকে ঘিরে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কাটাতে সরাসরি জানতে চাইলাম, যে বইমেলা মঞ্চে এই পদক দেয়া হলো সেই অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর আহ্বায়ক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ নেছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জুর কাছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জুরি বোর্ডে নামটি উত্থাপন এবং অনুমোদন হওয়ার পরে রিভিউর সময় হয়তো বাতিল হয়েছে।’

কোন অভিযোগে বাতিল হলো, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রিভিউর সময় কেউ কেউ বলেছেন, আরো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি রয়ে গেছেন। তাই ওনাকে (অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদকে) দেয়া যায়নি।’

কার বা কাদের এমন মত বা অভিযোগ এবং সেই রিভিউ বোর্ডে কারা আছেন, জানতে চাইলে বইমেলার এই আহ্বায়ক বলেন, ‘পদকটি আসলে বইমেলা কমিটির নয়, এটি সরাসরি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দিয়ে থাকে।‌ জুরি বোর্ডও সিটি কর্পোরেশন গঠন করে থাকে।' মেলার এই আহ্বায়ক আরো বলেন, 'পদক দিলেও দোষ। না দিলেও দোষ। পদক দিয়ে তো আর বিতর্কিত হতে চাই না।’

বইমেলা কমিটির আহ্বায়কের এমন মতামতের পর প্রিয় মেয়র, আপনিই এখন পারেন সব বিতর্ক থামাতে…।

পদক নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার সম্মানজনক সমাপ্তি জরুরি

চট্টগ্রামের মানুষ আপনাকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্পষ্টবাদী হিসেবে জানেন। পাশাপাশি লেখক-গোষ্ঠী আপনাকে জানেন একজন লেখক, রাজনৈতিক গবেষক হিসেবেও। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখক শিক্ষক শিক্ষাবিদ ও ভাষাসংগ্রামী রাজনীতিবিদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার উদারনৈতিক আদর্শের পথেই আপনি হাঁটবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের 'বালখিল্য প্রলাপে' কিংবা অন্ধকারের কোনো গোপন আপত্তির মুখে বিভ্রান্ত হয়ে নয়, উত্তরপ্রজন্মের কাছে রাজনৈতিক শিষ্টাচার, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার বার্তা পৌঁছে দিতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কে জড়ানো অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদ-এর একুশে সম্মাননা পদক নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার সম্মানজনক সমাপ্তি হওয়া দরকার।

আপনার সমীপে আবেদন, দু-চারজন বায়বীয় নপুংশকের কথায় এই পদক প্রদান প্রক্রিয়া আটকে যাওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক নিন্দার ঝড় ওঠেছে। এই নিন্দার ঝড় থামাতে পারেন একমাত্র আপনি।

চট্টগ্রামবাসীকে দায়মুক্তি দিন

আমি জানি, পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় মেয়র হিসেবে আপনি নিজেই স্বাক্ষর করেছেন। 'হাকিম নড়ে কিন্তু হুকুম নড়ে না' বলে একটি কথা বাংলায় প্রচলিত আছে। তাই পদকটি প্রদান প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ার কথা নয়।

শেষ করতে চাই, চট্টল শহরের মেয়র হিসেবে আপনার কাছে একটি চাওয়া নিয়ে। জানি, চাওয়াটুকু একজন মেয়রের কাছে খুব বেশি চাওয়া নয়। বিশ্বাস করি, মেয়র হিসেবে আপনি নিজেই এই মরণোত্তর পদকটি নিয়ে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদের পরিবারের কাছে ছুটে যাবেন এবং পদকটি তুলে দিয়ে চট্টগ্রামের মানুষকে দায়মুক্ত করবেন। নতুবা বিকল্প আরেকটি সমাধান হতে পারে। 'চসিক একুশে পদক' যাঁর নামে স্থগিত রাখা হয়েছে, তাঁকে ক'দিন পরেই 'স্বাধীনতা পদক' দেয়া হোক। 

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী

সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন। বিশেষ প্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: