গবেষক আহমদ মমতাজ মনের মন্দিরে নিয়েছে ঠাঁই
লিখেছেন : শহীদুল ইসলাম শহীদ
লেখক, গবেষক আহমদ মমতাজের মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৯ মে। ২০২১ সালের এদিনে তিনি মাত্র ৬১ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালের বাসিন্দা হন। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও সংগঠক।
আহমদ মমতাজ ১৯৬০ সালের ২০ জুন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল বারিক ও মা আমেনা খাতুন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে পরবর্তীতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেন। ৯০ দশকের দিকে, ব্যাংক ছেড়ে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। ১৯৯২ সালে ঢাকায় মুদ্রণ ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগদান এবং পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির লোকজ সংস্কৃতি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে হয়ে ওঠেন নিবিষ্ট এক গবেষক। ২০১৪ সালে আহমদ মমতাজ বাংলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদায় যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
চার দশক ধরে সাহিত্যচর্চা, গবেষণা, সামাজিক– সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রবন্ধ,গল্প, ইতিহাস–ঐতিহ্য বিষয়ক অনুসন্ধানীমূলক অসংখ্য রচনা ও সম্পাদনার কাজ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে আহমদ মমতাজ একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও গবেষক হিসেবে সুধীমহলে প্রশংসিত হয়েছেন।
তাঁর সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। তাই খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সাঈদ স্যারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মমতাজ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমি তখন বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকার রিপোর্টার। মমতাজ ভাই বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ সম্পাদক সৈয়দ উমর ফারুক ভাইয়ের চট্টগ্রাম কলেজের বন্ধু ছিলেন।
ড. সাঈদ স্যার ছিলেন তাঁদের প্রিয় শিক্ষক। প্রিয় শিক্ষকের সংবর্ধনায় যোগ দিতে মমতাজ ভাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। ফারুক ভাইয়ের মুখে মমতাজ ভাই সম্পর্কে অনেক জেনেছি। চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা সংসদ,দেয়ালিকা প্রকাশ, সাহিত্য সংকলন প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন মমতাজ ভাই। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পাস করে নিজ এলাকা মিরসরাইয়ে শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এরপর কাজ করেছেন ব্যাংকে, সাংবাদিকতা করেছেন ঢাকা ও কলকাতার পত্রিকায়। সাপ্তাহিক দশদিশা, দশদিশা প্রকাশনী, মুদ্রণ শিল্প- সবশেষে বাংলা একাডেমি। সবখানে নিজ মেধা ও কর্মগুণে দ্যুতি ছড়িয়ে অমর হয়ে আছেন গবেষক আহমদ মমতাজ ভাই।
২০০৪ সালে আমি সরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকায় আসার পর তাঁর সাথে আমার আবারো দেখা। শুরু হয় আমাদের পুরানো সম্পর্ক ঝালাই। আরামবাগের ১২৯ আনিছা বেগম ভিলায় আমার বাসা। মমতাজ ভাইয়ের বাসায়ও তার পাশে। ১২৪ লাল কুটির,আরামবাগ। এরপর থেকে তাঁর বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল, আমাকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। মমতাজ ভাইয়ের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা আমাকে বিমোহিত করত। তাঁর বাসায় গেলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা, মিরসরাই সমিতি ঢাকাসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনের আমৃত্যু নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। চট্টগ্রাম সমিতিতে দীর্ঘদিন প্রচার প্রকাশনা সম্পাদক, সাহিত্য ও সেমিনার সম্পাদক হিসেবে নিজের মেধা ও মননকে সমিতির জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম সমিতির নির্বাহী কমিটিতে (২০১২-২০১৫) চার বছর আমি তাঁর সাথে কাজ করেছি। সমিতির প্রকাশনা চট্টলশিখা, লেখক সম্মেলনে মমতাজ ভাইয়ের সাথে থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। চট্টগ্রাম সমিতির ইতিহাসগ্রন্থ রচনায় কি অপরিসীম কষ্ট তিনি করেছেন তা বর্ণনাতীত, এর পরেও নানা ঘটনায় তাঁকে মনোকষ্টে ভুগতে হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমিতিতে তিনি অনেক কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। একারণে তিনি মাঝে মাঝে হতাশও হয়েছেন।
আমাকে খুব স্নেহ করতেন বলে অনেক সুখ,দুঃখের কথা শেয়ার করতেন। ২০১৬ সালে আমি ঢাকা থেকে চলে আসার পরও নিয়মিত কথা হতো তাঁর সাথে। কথা বললে শেষ হতো না। অনেক সময় মুঠোফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যেত। কলব্যাক করতাম হয় আমি, না হয় তিনি। লেখালেখি করতে তিনি আমাকে খুব তাগিদ দিতেন। বলতেন, মরে গেলে সবাই ভুলে যাবে। লেখালেখির মাঝে কিছুটা হলেও বেঁচে থাকা যাবে। মমতাজ ভাইয়ের সাথে আমার এসব স্মৃতি বায়োস্কোপের চিত্রের মতো এখন বারবার মানসপটে ফিরে আসে।
তিনি অনেক গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থগুলো রচনা করতে গিয়ে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন ,নিজের শরীরের দিকে নজর দেননি। তিনি বলতেন, চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাস এখনো অজানা। চট্টগ্রামের আনাছে কানাছে যে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা, নিদর্শনের কথা শুনলেই গবেষক আহমদ মমতাজ ছুটে যেতেন। সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী লেখক রাইহান নাসরিন। লেখালেখি ও গবেষণায় তিনি সবসময় মমতাজ ভাইকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করতেন। মমতাজ ভাইয়ের অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে নাসরিন ভাবী এখনো রাত দিন কাজ করে যাচ্ছেন। মৃত্যুর পর ভাবী বেশ কয়েকটি বই প্রকাশও করেছেন, জীবদ্দশায় এই বইগুলো প্রকাশ পেলে মমতাজ ভাই সবচেয়ে খুশি হতেন!
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সদালাপী, মৃদুভাষী, হাস্যোজ্জ্বল, নিরহংকারী এবং প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানবিক মানুষ ছিলেন। আমি তাঁকে কখনো রাগতে দেখিনি তবে তাঁর মধ্যে আমি চাপা অভিমান দেখেছি। তাঁর অভিমান প্রকাশের ধরণটিও ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। কারো বিরূপ আচরণে তিনি চুপচাপ থেকে নিরবেই সহ্য করে যেতেন।
ইতিহাস- ঐতিহ্যের প্রতি অসামান্য দায়বোধ আহমদ মমতাজকে সবসময় তাড়া করত, তাই তিনি কখনো স্থির থাকতে পারেননি,তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহরে-বন্দরে এমনি কলকাতা- আগরতলায়ও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর লেখনিতে উন্মোচিত হয়েছে নতুন নতুন তথ্যের ভাণ্ডার, ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়। এখানেই গবেষক আহমদ মমতাজের লেখার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিহিত ছিল। প্রত্যেক সফল মানুষের সাফল্যের পেছনে কাজ করে তাঁর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। সেই বিবেচনায় দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী আহমদ মমতাজকে এক সফল লেখক, সফল গবেষক বলা যাবে নিঃসন্দেহে। কবি বলেছেন-
সেই ধন্য নর কূলে
লোকে যারে নাহি ভুলে
মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন।
আহমদ মমতাজ লিখে গেছেন গণমানুষের জন্য,ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। তাই তিনি মানুষের মনে,ইতিহাসপ্রেমীদের অন্তরে বেঁচে থাকবেন আজীবন। মহান আল্লাহ্ গবেষক আহমদ মমতাজ ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।
লেখক : শহীদুল ইসলাম শহীদ, সরকারি কর্মকর্তা ; সাবেক দপ্তর সম্পাদক, চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা।