Cvoice24.com

ই-কমার্স ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

অর্পিতা চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ই-কমার্স ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ডিজিটাল বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ছোট থেকে বড় ব্যবসা বর্তমানে বিশ্বের সবদেশে জনপ্রিয়। বাংলাদেশে সীমিত আকারে হলেও ব্যবসার এ ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে এবং ভোক্তা বা ক্রেতাদের মাঝে জনপ্রিয় হচ্ছে,পাচ্ছে গ্রহণযোগ্যতা।

ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবসার মূল সুবিধা হচ্ছে মাল মজুদের জন্য অনেক বড় স্থানের প্রয়োজনহীনতা। আমরা যদি আমাজনকে উদাহরণ হিসেবে নেই সেখানে বিক্রেতা বিবিধ কোম্পানি,আমাজন বিভিন্ন বিক্রেতা থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। এখানে আমাজনের একক কোন ওয়্যারহাউজ সর্বত্র মেইনটেইন করতে হচ্ছে না। এখানে মূল্য সাশ্রয় হচ্ছে অনেকভাবে যেমন পণ্য রাখার স্পেসের জন্য ভাড়া গুণতে হচ্ছে না,অন্যদিকে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের আলাদা করে মার্কেটিং,এডভার্টাইজিং ও সেলস এর জন্য যে অর্থ বিনিয়োগ দরকার হয় তা বেঁচে যাচ্ছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসার এ ক্ষেত্রকে ই-কমার্সের আওতায় যদি আমরা ব্যাখ্যা করি তাহলে এখানে অন্তর্ভুক্ত হবে ব্যবসায়ীরা ও ভোক্তা বা ক্রেতারা। ইনফরমেশন টেকনোলজিকে (IT)  টার্গেট করে বাংলাদেশে ই-কমার্সের ফ্রেমওয়ার্ক ডিজাইন করা হয়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট প্রোভাইডার যারা আছে অর্থাৎ ব্রডব্যান্ড সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিগুলো।

B2C (Business to Consumers),B2B (Business to Business), B2G (Business to Government), G2B (Government to Business) এ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে ই-কমার্সের নীতিমালার আওতা গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও খুচরা বা রিটেইল যে ব্যবসা তাই ডিজিটাল মাধ্যমে বেশি যা B2C এর আওতাধীন। B2B এর ভিত্তি হলো সিকিউরড অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে-এখানে অকশন,বিডিং এসবও অন্তর্ভুক্ত। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোন ব্যবসা যখন গভঃ এর সাথে করা হয় সেটা B2G বলে বিবেচিত হয় যেমন টাইগার আইটি ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করছে। তারা গভ: এর সাথে চুক্তি করেছে। ই-টেন্ডার,ই-চালান এসব হচ্ছে G2B যা গভঃ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যভার করার সুযোগ দিচ্ছে,কেউ সশরীরে না উপস্থিত হয়ে তার টেন্ডার দাখিল করতে পারছে।

ই-কমার্সের ক্ষেত্রে প্রথম আইনী পদক্ষেপ হচ্ছে সেল্ফ রেগুলেশন-আমি অনলাইনে মাদক বা অস্ত্র বিক্রি করব না। এটাই সেল্ফ রেগুলেশন। অর্থাৎ প্রচলিত যে আইন স্থাবর ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য তা ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। ই-পেমেন্টের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো অনেকসময় নির্দিষ্ট এমাউন্ট কার্ডে ব্লক করে রাখে ট্রাঞ্জেকশন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত। এটা পেমেন্টের যে অনিশ্চয়তা তা অনেকটাই দূর করে। গ্রাহকের ও ব্যবসায়ীর তথ্য গোপন ও সুরক্ষিত রাখা ই-পেমেন্টের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট কোম্পানির দায়িত্ব আইনগতভাবে।

সাইবার দুনিয়া যেহেতু ফ্লুইড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল তাই দেশ,স্থান,পণ্য,পরিস্থিতি সব বিবেচনায় রেখেই আইসিটি এক্ট শুধু জারি করলেই হবে না এর সংযোজন,বিয়োজন,পরিমার্জন,পরিবর্ধন কিছুদিন পর পরই করতে হবে। চলমান আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ই-কমার্সের আইন তৈরী হলে সবদিক থেকেই তা ফলপ্রসূ হবে। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ডিজিটাল সার্টফিকেশন চালু আছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্রেতাদের সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অপারেশনাল গাইডলাইন তৈরী করেছে। স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা,দায়িত্ব নিয়ে যেন ডিজিটাল কমার্স এগিয়ে যেতে পারে এবং কর্ম সংস্থান তৈরী করতে পারে সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ জ্ঞাপন করেছে। সম্প্রতি করা গাইড লাইনে MLM (Multi Level Marketing) কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মাদক-বিস্ফোরক বিক্রি,জুয়া খেলা এগুলো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের লাইসেন্স ছাড়া অনলাইনে ওষুধ,মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট বিক্রিও আইনীভাবে স্বীকৃত না।

তথ্য সুরক্ষা করা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ গাইডলাইনে বলা হয়েছে যদি বিক্রেতার ওয়েবসাইটে Cookies থাকে তা অবশ্যই ক্রেতা ওয়েবসাইটে প্রবেশের সাথে সাথে যেন পপ আপ মেসেজ পায় সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। ক্রয়-বিক্রয়ের সময় যদি কোন ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদানের দরকার হয় ক্রেতাকে অবশ্যই তা অবহিত করতে হবে,কোথায় তথ্য রক্ষিত হবে তা সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে,তথ্য কোথায় ব্যবহৃত হবে তা উল্লেখ থাকতে হবে তারপর ক্রেতার সম্মতি নিতে হবে। ওয়েবসাইটে এসবের জন্য ধাপে ধাপে চেকবক্স থাকতে হবে।

প্রত্যেক ডিজিটাল কমার্স বিজনেসের ট্রেড লাইসেন্স নাম্বার থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নাম্বার, TIN, UBIN (Unique Business Identification Number) যার জন্য যা প্রযোজ্য তা সংগ্রহ করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া বা ওয়েবসাইটে পেইজ থাকতে হবে যা PRA (Personal Retail Account)  নামে অভিহিত।

ডিজিটাল কমার্স বিজনেসে গভঃ এর S.294(B) of the Penal Code 1960 এর অনুমতি ছাড়া কোন লটারি বা র‍্যাফেল ড্র এর আয়োজন করা যাবে না।

ডিজিটাল কমার্স এর মার্কেটপ্লেসে বা সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে কেনাবেচা,মূল্য ফেরত,পণ্য ফেরত,পণ্য বদল,পণ্য সরবরাহের পদ্ধতি,সরবরাহের সময়,অন্যান্য শর্তাবলী অবশ্যই পরিষ্কার বাংলায় লেখা থাকতে হবে। বাংলার সাথে অন্য ভাষায় ও প্রয়োজনে লেখা যাবে। বাংলাদেশের প্রচলিত কোন আইনের সাথে সাযুজ্য পূর্ণ নয় এমন কিছু মার্কেটপ্লেসে বা সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে উল্লেখ করা যাবে না।

অন্য দেশের কোন ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ডিজিটাল কমার্সের আওতায় ব্যবসা করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন সংগ্রহ করতে হবে।

পণ্যের বর্ণনা,ছবি,আকার,ওজন,রং,কোথায় তৈরী,তৈরীর তারিখ,উপাদান,মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোন উপাদান আছে কি না,পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক কি না এসব সব উল্লেখ থাকতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোয়ালিটি কন্ট্রোল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে।

ডেলিভারি ম্যানকে পণ্যের মূল্য বুঝে পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য সরবরাহের জন্য দিতে হবে,ক্রেতাকে ফোন,ইমেইল বা টেক্সটের মাধ্যমে জানাতে হবে যে তার পণ্য শিপিং হচ্ছে। ক্রেতা বিক্রেতা একই শহর বা গ্রামে থাকলে ৫দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ আবশ্যক। শহর বা গ্রাম ভিন্ন হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে।

যে পণ্য একদম সরবরাহের জন্য তৈরী সেক্ষেত্রে শতভাগ মূল্য অগ্রিম নেয়া যাবে। যদি আউট অব স্টক হয় তাহলে ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম মূল্য নেয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে সামান্য ব্যত্যয় করার সুযোগ রেখেছে Escrow Service এর মাধ্যমে। অর্থাৎ ক্রেতা শতভাগ মূল্য দিলো বিক্রেতা এখনো পণ্য দেয়নি এক্ষেত্রে পরিশোধিত মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্টে থাকে,ক্রেতা পণ্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক তা বিক্রেতার একাউন্টে ট্রান্সফার করে।

ডিজিটাল কমার্সের আওতায় যারাই ব্যবসা করবে তাদের ক্রেতার অভিযোগ নেয়ার নির্দিষ্ট সেল থাকতে হবে,যারা ভোক্তা অধিকার বিভাগের সাথে সমন্বয় করে কাজ করবে। অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং ৭২ ঘণ্টার ভেতর অভিযোগকারীকে যোগাযোগ করতে হবে ফোন,ইমেইল বা টেক্সটের মাধ্যমে। বিক্রেতার ওয়েবসাইটে রিভিউ,রেটিং দেয়ার সুযোগ রাখতে হবে। কোন দৈব দুর্বিপাক বা অপ্রত্যাশিত কারণ ঘটলে যা বিক্রেতার নাগালের বাইরে যদি বিক্রেতা পণ্য সরবরাহ করতে অপারগ হয় তাহলে  ক্রেতাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে,৭২ ঘণ্টার ভেতর মূল্য ফেরত দিতে হবে। অন্য যে কোন কারণে ডেলিভারি দিতে বিলম্ব ঘটলে ১০ দিনের ভেতর পূর্ণ মূল্য ক্রেতাকে ফেরত দেয়া নিয়ম।

পণ্যভিত্তিক,সেবা ভিত্তিক যে ব্যবসাই কেউ করুক না কেন তাকে ডিজিটাল কমার্সে অনলাইন ট্রাঞ্জেকশন করতে হবে। একক ব্যবসা,কোম্পানি বা এসোসিয়েশনের ব্যবসা,ডোমেইন ভিত্তিক ব্যবসা,ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির ব্যবসা,সোশ্যাল মিডিয়ার পেইজ ভিত্তিক ব্যবসা সবই ই-কমার্সের আওতায় করা সম্ভব।

ই-কমার্সের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যখন পণ্য কিস্তিতে কেনা হয় সেখানে বিক্রেতার পেমেন্ট প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা দেয়া;ডিজিটাল যে ফ্রড হয় তা চেক এন্ড ব্যালেন্স করা,পণ্যের মান বজায় রাখা,ভেজাল নকল পণ্য চিহ্নিত করা,ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির অপব্যবহার, কপি করা রোধ করা,ডাটা বা তথ্যের অপব্যবহার রোধ করা।

এ মুহূর্তে Digital Commerce Act,2023 নিয়ে কাজ চলছে। ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন,১৯৩০ সালের পণ্য বিক্রি আইন, ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার আইন,হালের সাইবার সিকিউরিটি এক্ট এর সাথে সংযোজন বিয়োজন করে,যুগের চাহিদা মাথায় রেখে পূর্ণ Digital Commerce Act জারি ও প্রয়োগ করা বাংলাদেশের ক্রম বর্ধমান ই-কমার্সের জন্য এখন সময়ের দাবী।

অর্পিতা চৌধুরী/ আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট


 

 

 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়