বিএম কন্টেইনার ডিপোর তথ্য গোপন অব্যবস্থাপনায় বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি— পুলিশের অভিযোগ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:১৬, ৯ জুন ২০২২
বিএম কন্টেইনার ডিপোর তথ্য গোপন অব্যবস্থাপনায় বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি— পুলিশের অভিযোগ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের অবহেলা, তথ্য গোপন ও চরম অবস্থাপনাকে দায়ী করছে পুলিশ। দুর্ঘটনার পর থেকে এসব অভিযোগ উঠলেও এবার পুলিশের করা মামলাতেই বিএম কনন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনেছে পুলিশ। 

পুলিশের অভিযোগ—  ডিপোতে কেমিক্যাল ভর্তি ড্রাম কন্টেইনার রাখা হলেও আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাছে তা গোপন রাখা হয়। তাছাড় অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের ফায়ার ফাইটিংয়ের পর্যান্ত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত জনবলও ছিল না। কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থের আগুন নেভানোর মত কোন প্রকার প্রস্তুতিও না থাকলেও সেখানে টনে টনে কেমিক্যালের মজুদ করা হয়। 

মঙ্গলবার রাতে সীতাকুণ্ড থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকীর করা মামলার এজহারেই এসব অভিযোগ আনা হয়। মামলায় বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃক্ষের ৮ কর্মকর্তাকে আসামি করা হলেও আসামির তালিকায় নাম নেই মালিক পক্ষের কেউ। মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৩৭/৩৩৮/৩০৪ এর ক/৪২৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। 

গত ৪ জুন রাতে সংঘটিত এ দুর্ঘটনার পর দায়ের করা প্রথম মামলাটিতে আসমিরা করা হয়— বিএম কন্টেইনার ডিপো লিমিটেডের ডিজিএম নুরুল আক্তার, ম্যানেজার অ্যাডমিন খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন নজরুল ইসলাম ও জিএম নাজমুল আক্তার খান। যদিও মালিক পক্ষের কাউকে আসামি করা হয়নি। 

সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে।’ 

এদিকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম (সীতাকুণ্ড) জানিয়েছেন, আসামির তালিকায় ডিপোর কর্মকর্তারা থাকলেও প্রাথমিকভাবে মালিক পক্ষের কাউকে রাখা হয়নি। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে, তদন্তে যদি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, মালিকদেরও আসামি করা হবে।

গত শনিবার (৪ জুন) বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। রাত পৌনে ১১টায় এক কনটেইনার থেকে অন্য কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে টানা ৭২ ঘণ্টা পর আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৪৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুই কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এই ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয় ২০১১ সালে। এর মালিকানায় আছেন বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার ছোট ভাই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান। স্মার্ট গ্রুপের আরেক কোম্পানি আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির জন্য রাখা ছিল কনটেইনার ডিপোতে। ওই রাসায়নিকই আগুনকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা।

সীতাকুণ্ড থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকীর করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়— ‘বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রপ্তানীমুখী ও আমদানিকৃত গার্মেন্টস পন্যসহ সাধারণ পন্য ভর্তি কন্টেইনারের পাশাপাশি কেমিক্যাল ভর্তি ড্রাম কন্টেইনার রাখা হত। কিন্তু অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের ফায়ার ফাইটিংয়ের পর্যান্ত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না। কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থের আগুন নেভানোর মত কোন প্রকার প্রস্তুতিও তাদের ছিল না ‘

এতে আরও অভিযোগ আনা হয়, গত ৪ জুন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এই সময়ে বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে কেমিক্যালের ড্রাম ভর্তি কন্টেইনার থাকার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে অবহিত করেনি। ফলে কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনারের আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। উপরন্ত কেমিক্যালের প্রভাবে আগুন ব্যপকভাবে অন্যান্য কন্টেইনারে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে কেমিক্যালের ড্রাম ভর্তি ৬/৭টি কন্টেইনার একযোগে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অনেকগুলো ভবনের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরিত কন্টেইনারের ছড়িয়ে পড়া টুকরার আঘাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত অগ্নি নির্বাপন এবং উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ হতাহত হয়।’

এজহারে আরও উল্লেখ করা হয়— ‘বিএম কন্টেইনার ডিপোতে কর্মরত আসামীগন কন্টেইনার ডিপোতে যথাযথ সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিপদজনক কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনার রাখা, অগ্নিকাণ্ডের পর উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কন্টেইনারের ভিতর কেমিক্যাল ভর্তি ড্রাম থাকার বিষয়টি অবহিত না করা। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জাম ও তাৎক্ষনিক ভাবে মোকাবেলা করার মত প্রশিক্ষিত জনবলের ব্যবস্থা না রাখার ফলে উল্লেখিত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় বিপুল সংখ্যাক মানুষ হতাহত হয়। এছাড়াও সম্পদের ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয়। আসামিদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারনে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৩৭/৩৩৮/৩০৪ এর ক/৪২৭ ধারায় মামলা করা হয়।’  
 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়