Cvoice24.com

চবির চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে ফেরাতে আন্দোলন— সমাধান কোন পথে? 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ১৫ নভেম্বর ২০২২
চবির চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে ফেরাতে আন্দোলন— সমাধান কোন পথে? 

গত ২ নভেম্বর থেকে টানা ১৩ দিনের মতো ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চারুকলা ইনস্টিটিউট মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনে আছেন শিক্ষার্থীরা। চারুকলার ইনস্টিটিউটের শ্রেণিকক্ষ সংস্কার, আবাসিক হলের ব্যবস্থাসহ ২২ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও এখন মূল দাবি চারুকলাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই স্থানান্তর করা। গত ২ নভেম্বর থেকে টানা ১৩ দিনের মতো ক্লাস বর্জন করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরমধ্যে শিক্ষার্থী ও ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের সাথে দফায় দফায় সভা করেও পরিষ্কার কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এখন প্রশ্ন হলো— এ সমস্যার সমাধান কোন পথে?

চারুকলা ইন্সটিটিউটের যাত্রা যেভাবে

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১০ বছর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মাসে কোন প্রকার ঘোষণা ছাড়াই চারুকলাকে ক্যাম্পাস থেকে নগরের বাদশামিয়া রোডস্থ এলাকায় স্থানান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে টানা তিন মাস ইনস্টিটিউটসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মানববন্ধন করেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। সেই সময় ২০০ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৩৭ জন সরাসরি জড়িত ছিলেন এই আন্দোলনে। এর মধ্যে বিভিন্ন পরীক্ষায় বেতনভাতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। তাৎক্ষণিক আন্দোলন দমাতে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। প্রায় দুই মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় চারুকলার শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরে চারুকলা ক্যাম্পাস থেকে তল্পিতল্পাসহ গুটিয়ে স্থানান্তরিত হয়ে যায় চট্টগ্রাম নগরে।

২০০৪ সালের চারুকলা বিভাগের ৫১ তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘চারুকলা বিভাগের স্থানান্তরের কারণে আমরা মূল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক প্রকার আলাদা হয়ে যাই। প্রশাসন আমাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এখনে নিয়ে আসার কথা বললেও এই স্থানান্তর আমাদের জন্য হয়ে কাল হয়ে দাঁড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, 'শহরে থাকায় বাড়ে দৈনন্দিন থাকা-খাওয়ার খরচ। ইনস্টিটিউটে সীমিত ছাত্রদের সুবিধা থাকলেও যাওয়া আসার সুবিধার কারণে অনেকেরই শহরে থাকতে হয়েছে। সেইসময় পাঁচ রুমের একটি হোস্টেল ছিল। পরে সিট নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার রাজনীতি। ছাত্রীদের ছিলনা থাকার কোনো সুবিধা। অনেকেরই মেহেদীবাগ এলাকায় রুম ভাড়া করে থাকতে হয়েছে।’

ক্যাম্পাসে ফিরার দাবি জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, 'আমরা যারা সাবেক আছি, তারাও চাই চারুকলা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে ফিরে আসুক। যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চারুকলা হলো মূল অলংকারের মতো। তারা মূল ক্যাম্পাসে আসলে ক্যাম্পাস আরও রঙিন হয়ে ওঠবে।'

স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে দুই মামলা

২০১১ সালে নগরের মেহেদিবাগ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে আত্মীকরণ এবং প্রতিষ্ঠানের সকল সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক হস্তান্তরকে সম্পূর্ণ অবৈধ উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। পরে উচ্চ আদালত এই রায় স্থগিত রাখেন। এর আগে ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে সমন্বয় করে ইনস্টিটিউট তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রশাসন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একই বছরের ১১ মার্চে তৎকালীন চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ও স্থপতি সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ সুপ্রীম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। 

পরে সিদ্ধান্তে সমন্বয় হয়ে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটি, পরিকল্পনা কমিটি ও অনুষদ কমিটি একত্রে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিলরসহ একটি সিন্ডিকেট কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে বিভাগের একদল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আপত্তি করলে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইন্সটিটিউট নির্মাণের এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে স্থগিত রাখা হয়। পরে ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ৪৬২ তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে চারুকলা বিভাগ এবং চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে একসাথে করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

ক্যাম্পাসে ফেরা এখন মূল দাবি

গত ৩ নভেম্বর থেকে ২২ দফা দাবিতে আন্দোলনরত চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের এখন মূল দাবি চারুকলাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা।

সেই ২২ দফার মধ্যে ছিল— শিক্ষার্থীদের নিজস্ব বাস চালু, ডাইনিং ও ক্যান্টিন তৈরি, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, বেসিনের সুব্যবস্থা রাখা, পর্যাপ্ত ওয়াশরুম নির্মাণ, আর্ট ম্যাটারিয়ালসের ব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পাঠাগার সংস্কার, জেনারেটরের ব্যবস্থা, মেডিকেল ব্যাকআপ, খেলাধুলার পর্যাপ্ত ইনসট্রুমেন্টের ব্যবস্থা, মেয়েদের থাকার হলের ব্যবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নির্মূল, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক সংকট নিরসন, ছাত্র ও ছাত্রী মিলনায়তনের ব্যবস্থা, সেমিনারের পরিধি বাড়ানো, ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিতকরণ, অজুখানা ও নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা, সন্ধার পর পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য লকারের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং ছাত্রদের হলের ব্যবস্থা।

৫৬ তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী সিভয়েসকে বলেন, 'প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পর থেকে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিবেশ পাইনি। কোন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ছাত্রী সেটা অনুভব করতে পারেনা। চারুকলা ইনস্টিটিউট একটি পার্ক মনে হয়। আমাদের ক্লাসের সময় বাইরের মানুষ এসে বিনোদনের খোরাক খুঁজে। গত ১৩ দিন যাবৎ চারকলা ইনস্টিটিউটে অবস্থান করছি। ইতোমধ্যে তিনবার শিক্ষকদের সাথে ছাত্র-ছাত্রী প্রতিনিধিদের সাথে বসা হয়েছে। তার পরেও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি প্রশাসন। যত দিন অব্দি কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।'  

৩৩ তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সায়েম হোসেন বলেন, 'চারুকলা বিভাগের স্থানান্তরে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। উল্টো এর সুবিধা লুটেছে আমাদের শিক্ষকরা। শহরে বসেই মন মর্জি মতো আমাদের ক্লাস নিয়েছে। এমনও দিন গিয়েছে আমরা ক্লাসে বসেছিলাম স্যারের অপেক্ষায়। তাঁরা তাদের নিজস্ব কাজ শেষ করে বিকাল ৫টায় এসে আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে চলে গিয়েছে।'

আন্দোলনকারী আরেক ছাত্র মাসরুল ফাহিম সিভয়েসকে বলেন, 'চট্টগ্রাম দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এই সংকট-বঞ্চনা-অসহায়ত্বের নিরসন আমরা সকলে চাই। আমরা সবাই প্রশাসন ও শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসতে চাই। কমিটির জটিলতা নিয়ে আরো ভুক্তভোগী হতে আমরা রাজি না এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো।'

গত ২ নভেম্বর থেকে টানা ১৩ দিনের মতো ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা

দফায় দফায় বৈঠকে মেলেনি সমাধান

চলমান আন্দোলনের মধ্যে গত ৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও চারুকলা বিভাগের শিক্ষকরা বৈঠকে বসেন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সাথে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সাথে একমত পোষণ করলেও সহমত প্রকাশ করেন নি বিভাগের শিক্ষকরা। বৈঠকে শিক্ষকদের সাথে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে মিটিং বর্জন করতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। বৈঠকে শিক্ষকরা চারুকলার নিজস্ব ক্যাম্পাস চাইলেও শিক্ষার্থীরা চান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থানান্তর।

গত ১২ নভেম্বর চারুকলা ইনস্টিটিউটকে শহর থেকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কোনো সিদ্ধান্ত না জানিয়ে কমিটি করে প্রশাসন। চারুকলার শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই বৈঠক করেন উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টোরিয়াল টিম ও চারুকলার শিক্ষকরা। বৈঠক থেকে ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ মামুনকে প্রধান করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংকট নিরসনে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

পরবর্তী সময়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কমিটির বিষয়ে জানানো হলে তারা এ নিয়ে আপত্তি জানান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মনে করেন, চারুকলাকে ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না জানিয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন দীর্ঘ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

সার্বিক বিষয়ে চারুকলা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরীকে ফোন দিলেও সাড়া মেলেনি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একমত পোষণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আক্তার সিভয়েসকে বলেন, 'ছাত্ররা মূল ক্যাম্পাসে ফিরতে চাইছে এতে আমরা রাজী আছি। কিন্তু এই ব্যবস্থা করতে একটা সময় প্রয়োজন। ভিসি একা কিছুই করতে পারবে না। ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের হাতদিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের মতের একটা বিষয় আছে। তাছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউট যেসব জায়গায় পুনরায় সংস্থার প্রয়োজন সেসব অতি দ্রুত ঠিক করা হচ্ছে। আমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য বলতে চাই তারা যেন ক্লাসে ফিরে যায়।'

সিভয়েস/ডিসি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়