Cvoice24.com

পহেলা বৈশাখ বাঙালির সাংস্কৃতিক বিজয়

আশরাফুন নুর

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ১৪ এপ্রিল ২০২২
পহেলা বৈশাখ বাঙালির সাংস্কৃতিক বিজয়

জাতিগোষ্ঠী বা ভূখণ্ড ভেদে এ পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি ও উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ উদযাপনের রীতি প্রকৃতি বা পদ্ধতির মাঝেও রয়েছে ভিন্নতা। এসব উৎসবের মাধ্যমে তারা তাদের আত্মপরিচয়, নিজস্ব ঐতিহ্যকে খুঁজে পায়। সারা বছরের বিষাদময়তা, জরাজীর্ণতা, আড়ষ্টতাকে বিদায় দিয়ে সতেজ ও নতুন জীবনে প্রবেশ করে। এ প্রবেশ করার অনুভ‚তি প্রকাশ করার অন্য নামও এ নববর্ষ উৎসব। বছরের একঘেয়েমি জীবনকে সজীব করে তুলে এ উৎসব। আর বাঙালির এ উৎসবের নাম হলো ‘পহেলা বৈশাখ’ বা ‘বাংলা নববর্ষ’। 

পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বৈচিত্রময়। অবহমান কাল ধরে এসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের মাধ্যমে বাঙালি তার অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়ে আসছে। বাঙালির উৎসবগুলোর মধ্যে সার্বজনীন, অসম্প্রদায়িক সর্ববৃহৎ মিলনমেলা ও উৎসব হলো এ ‘পহেলা বৈশাখ’। এটি বাঙালির জাতীয় উৎসব। 

এ নববর্ষবরণ উৎসব বাঙালির জাতীয় পরিচয় তুলে ধরে বিশ্ব দরবারে এবং জানান দিয়ে যায় বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবগাথা যতসব কথা। এটি বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক বিজয়ও বটে। এ বিজয়ের ফলে সকল স¤প্রদায়ের স¤প্রীতির মেলবন্ধন ও সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে এ ‘পহেলা বৈশাখ’। 

পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির উৎসবের দিন, আনন্দের দিন, বর্ষবরণের দিন। বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি এই দিনটি পালন করে। যে সংস্কৃতি মানুষের তৈরি আবার সে সংস্কৃতি ছাড়াও মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব জাতি তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে তার সৃষ্ট সংস্কৃতিকেও আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, চর্চা করতে হয়, মনে-প্রাণে লালন করতে হয়। এ সংস্কৃতি কোন জাতির সামগ্রিক পরিচয়। এ সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে কিংবা এর খোঁজেই এ নববর্ষ উৎসব।

এক জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করে চেনার জন্য সবচেয়ে সহজতম উপায় হলো তাদের স্ব-স্ব সংস্কৃতি। প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে আত্মপরিচয় দিয়ে থাকে। কোনো জাতিকে জাগাতে হলে প্রথমত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাগাতে হয়। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক বিপ্লবই সেই রাষ্ট্রগোষ্ঠীর প্রধান শক্তি। সে শক্তির ওপর আঘাত হানলে সেই জাতি আর নীরব থাকতে পারে না, যা আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনগুলোতে লক্ষ্য করি। কোন জাতি তার সংস্কৃতি হারালে তার অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলে, তার স্বকীয়তাও হারিয়ে ফেলে। তাই যে জাতি মতো সংস্কৃতিবান সে জাতি ততো উন্নত, ততো সমৃদ্ধ।

প্রত্যেক জাতির ন্যায় বাঙালি জাতিরও নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তাই বাঙালিরা তাদের এ সংস্কৃতি মনে-প্রাণে লালন করে যায় বিভিন্ন উৎসব-পার্বনের মধ্য দিয়ে। সারা বছরের বিষণœতাকে কাটিয়ে উঠতে বাংলা সনের বছরের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে থাকে বাঙালি জাতি। 

সেদিন সুপ্রাভতের ফসলের মাঠ, সূর্যকিরণ, মৃদু বাতাসের সুর নতুনের বার্তা দিয়ে যায়। বাঙালির শাশ্বত কামনাই হলো এ নতুনের প্রতি প্রেম। বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে উৎসবের আয়োজন তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। এ দিনটি বাংলা বছরের প্রথম দিন। এ পহেলা বৈশাখ ধর্ম-বর্ণ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকল বাঙালি স¤প্রদায়ের সম্প্রীতির মিলনমেলার অপর নাম বাংলা নববর্ষ উৎসব। এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন উৎসব ও সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। যে উৎসবের জন্য বাঙালি জাতি অধীর আগ্রহে থাকে সারাটা বছর। এ পহেলা বৈশাখ প্রকৃতির নিয়মেই ঘুরে আসে প্রতি বছর। বাঙালিদের বাঙালি হয়ে ওঠা এ প্রকৃতি চেতনার ভেতর দিয়েই। তাই বাঙালি সংস্কৃতিতে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে মেলবন্ধন দেখা যায়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে এবং এর মর্যাদা সমুন্নত রাখে। তাই নববর্ষের সাথে বাঙালি সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ নিজস্ব বিচিত্র সংস্কৃতির রূপের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতিপরিচয় প্রকাশ করে বিশ্ব দরবারে। 

এ বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। এ নববর্ষের সংস্কৃতি চেতনার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে সচেতন করে সামনে এগিয়ে যায় নানা অঙ্গিকারে। এ পহেলা বৈশাখে বাঙালি জাতি সারাদিন উৎসবে-আনন্দে কাটায়। এই দিন বাঙালি তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, গান-লোকগান, কবিতা, গল্প ও নাটকের মধ্য দিয়েই চিরায়ত বাংলার ও ঐতিহ্য তুলে ধরে। সনাতন, জরাজীর্ণতার প্রতিক‚লে নতুনের আবাহন এ বৈশাখ। 

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ উপজাতি সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় মিলনমেলায় পরিণত হয় এই দিন। তাই পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এখন। বাঙালির এ নববর্ষ বা সংস্কৃতি উৎসব বিশ্বকে মোহিত করেছে। একটি অসম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মূলসূত্র ধরেই এ নববর্ষের সূচনা। আর এ সূত্রের জনক তৎকলীন ক্ষমতাসীন সম্রাট আকবর। তিনি ধর্মীয় সংস্কার ও কৃষকের উন্নত জীবন তৈরির ঘোষণা করেছিলেন এ উৎসবের মাধ্যমে। মূলত তার নির্দেশে হিজরি সন অনুসারে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বছরের গণনা তাদের বিভিন্ন মনীষী না ধর্মীয় গুরুর জন্মদিনকে ঘিরেই বছর গণনা করা হয়। বাংলা মাস তার ব্যতিক্রম। তাই বাংলা নববর্ষ প্রকৃতি নির্ভর লোক উৎসব, এ উৎসবে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। অতি প্রাচীনকাল থেকে এ উৎসব চলে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশে এ উৎসব খুব জাঁকজমকভাবে পালিত হয়। বাঙালি তার আত্মপরিচয় তুলে ধরতে প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত দিকগুলো ফুটিয়ে তুলে নানা আয়োজনে।

গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণ পহেলা বৈশাখের উৎসব বন্ধ ছিল। এবার মহামারির প্রকোপ থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। তাই বাংলা নতুন বছর ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এবার পরিচিত আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়