Cvoice24.com

৫০ বছরেও কান্না থামছে না শহীদদের স্বজনদের

মো. হাবিবুর রহমান, রাউজান

প্রকাশিত: ০০:১৯, ১৩ এপ্রিল ২০২১
৫০ বছরেও কান্না থামছে না শহীদদের স্বজনদের

রাউজানের জগতমল্ল পাড়া বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিচিহ্ন।

আজ ১৩ এপ্রিল। রাউজানের গণহত্যা দিবস। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে রাউজানের শোকাবহ একটি দিন। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে পাকিস্তানি দোসরদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে উপজেলার ১৩টি স্থানে সকাল সাতটা থেকে শুরু করে নির্মম ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেদিন নারকীয় গণহত্যায় ১৫৬ জন হিন্দু ও ১০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। 

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদদের স্বজনদের কান্না থামছে না। সেই দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’ —এমন লেখার উপর এখনো মূর্তি সদৃশ রূপ ধারণ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ। কেউ কেউ বধ্যভূমির স্মৃতিশোধে নামের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। 

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় রাউজান উপজেলার প্রায় ৬টি স্থানে গঠিত হয় মুক্তিসেনা সংগ্রহ ও সহায়ক কমিটি। সব কমিটিগুলোর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়প্রদানকারী, পথ-প্রদর্শনকারী ও যোগাযোগ রক্ষাকারীরা এক সূত্রে গাঁথা ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে গমন, প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে যথাস্থানে পৌঁছাতে সহায়তা করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বাঙালি নিধনে লিপ্ত হলে এদেশে তাদের দোসররা রাউজানে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী ও হিন্দু নিধনের নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে মগ্ন থাকে। 

সংশ্লিস্ট সূত্র মতে, ১৩ এপ্রিল বহু সংখ্যক হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক হয়ে রাউজানে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম মধ্য গহিরার শীলপাড়ায় গণহত্যা শুরু করে। তখন ৫ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে গহিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বিশ্বাস বাড়িতে হামলা করে ৩ জন হিন্দুকে হত্যা করে। বিশ্বাস বাড়ি থেকে কিছু মাইল পূর্বে রাস্তার পাশে বড়পোল পালিত পাড়ায় প্রবেশ করে আরও ৮ জন হিন্দুকে জড়ো করে হত্যা করা হয়। নিজ বাড়িতে স্থাপিত কুণ্ডেশ্বরী মাতৃমন্দিরে প্রার্থণারত অবস্থায় পাকসেনাদের গুলিতে মারা যান অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। এই দিন পূর্ব গহিরার বৈদ্যবাড়ি ও চৌধুরী বাড়িতে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষের হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মেরে বাড়ির জিনিসপত্র লুঠে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। রাস্তার পাশে বাড়ুই পাড়া গ্রামে ৪ জনকে হত্যা করে। জগৎমল্ল পাড়া ঘেরাও করে অগ্নিসংযোগসহ নির্বিচারে গুলি করে ৩৬ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। 

এছাড়া সুলতানপুর বণিকপাড়ায় ১১ জন, সুলতানপুর ছিটিয়া পাড়ায় ৯ জন, পরে আহত আরও দুইজনের মৃত্যু হয় বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। রাউজান পালিতপাড়ায় ১ জনকে হত্যা করা হয়। একই দিন দক্ষিণ রাউজানে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক হয়ে পাক সেনারা প্রবেশ করে প্রথমে নোয়াপাড়ায় ৩ জন মুসলমান ও ৯ জন হিন্দুকে হত্যা করে। এরপর পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তর পাড়ায় গিয়ে আশ্রিত শরণার্থীসহ ৬৯ জনকে হত্যা করেছিল। ঊনসত্তর পাড়ায় সংগঠিত হত্যাযজ্ঞটি সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। একই দিন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কাপ্তাই সড়কে পাক সেনাদের ব্রাশ ফায়ারের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। 

তৎমধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ছেলে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন চৌধুরী খালেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সম্পাদক আব্দুর রউফ, কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যাপক দিলিপ চৌধুরী প্রমুখ। এদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা বাশঁখালীর সাবেক এমপি সুলতানুল কবির। 

জানা যায়, সেদিন এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রাউজানের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু ভারতে শরণার্থী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হয়। হত্যার এমন নির্মমতা ছিল যে, অনেক পরিবারের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই। এদের নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি পাঁচ বছরের শিশু হতে আশি বছরের বৃদ্ধ। নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর এমন নৃশংসতা, বর্বরতা ছিল অবর্ণনীয়। 

বীর মুক্তিযােদ্ধা ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ‘১৩ এপ্রিল রাজাকার, আল বদর, আল সামস ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সমগ্র রাউজানে গণহত্যা চালায়। তাদের গুলিতে মুক্তিকামী অনেক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হয়েছে, আমরা সন্তুষ্ট।’ পরাজিত শক্তিরা এখনো ষড়যন্ত্র করছে, তাদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় মুক্তিযোদ্ধাসহ তাদের সন্তানরা প্রস্তুত বলেও জানান তিনি। 

রাউজানে গণহত্যা দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবদুল ওয়াহাব সিভয়েসকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। যুদ্ধ চলাকালীন ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ মুক্তিকামী মানুষের কাছে একজন লেফট্যানেন্ট কর্ণেল, একজন মেজর, দুইজন ক্যাপ্টেইনসহ ৭ জন সাধারণ সৈন্য আত্মসমর্পন করেছিল, এটার প্রতিশোধ নিতে ১৩ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তান বাহিনী রাউজান-রাঙামাটি সড়ক, রাউজান-কাপ্তাই সড়ক নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সৃষ্ট একাধিক বধ্যভূমি, যুদ্ধ স্থলগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চারটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে রাউজানের অবদান ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার মতো।’ 

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, প্রতিটি থানায় আরও ২টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের লক্ষ্যে নাম চেয়েছেন। রাউজান থেকে হলদিয়া সিকদার বাড়ি ও সুলতানপুর বণিক পাড়া বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে তারা জানান।  

এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক জোনায়েদ কবির সোহাগ সিভয়েসকে বলেন, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছে সরকার। রাউজানে প্রায় বধ্যভূমি সংরিক্ষত আছে, বাকী বধ্যভূমিও সংরক্ষণের প্রক্রিয়াধীন।’

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে রাউজানে একাধিক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়