নিলামের অপেক্ষায় সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনার, বন্দরের ইয়ার্ডে বাড়ছে জট

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ৪ জুন ২০২২
নিলামের অপেক্ষায় সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনার, বন্দরের ইয়ার্ডে বাড়ছে জট

ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা। মামলা জটিলতায় থমকে রয়েছে পণ্য ধ্বংস কার্যক্রমও। বর্তমানে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে রয়েছে নিলামযোগ্য সাড়ে চার হাজার কনটেইনার। এসব কনটেইনারে ৮২ হাজার টনেরও বেশি আমদানি পণ্য রয়েছে। সে সঙ্গে খোলা পণ্য রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মেট্রিকটন। দীর্ঘদিন ধরে নিলামের অপেক্ষায় থাকা কনটেইনারের ভেতরের অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে একদিকে বন্দরের পরিবেশ নষ্ট করছে। অন্যদিকে বন্দরে কনটেইনার জটও তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি গুণগত মান হারিয়ে নিলামে তোলা পণ্যগুলো বিক্রি না হওয়ায় সরকারও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

৩১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২টি। সেখানে ২০২২ সালে এসে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজার নিলামযোগ্য কনটেইনার রয়েছে। এসব কনটেইনারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ, মাছ, আপেল, মাল্টা, মাছের খাবার, শস্য বীজ, লিকুইড ড্রিংকস, ম্যান্ডারিনসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, আমদানি করার ৩০ দিনের মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাস না করলে নিলামের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসকে চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রতি মাসেই রুটিন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে যাচ্ছে কাস্টমসকে। কিন্তু আমদানিকারকের মামলাসহ নানা জটিলতায় নিলাম ও পণ্য ধ্বংস কার্যক্রমে ধীরগতি তৈরি হয়েছে। 

অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, মিথ্যা ঘোষণায় কম শুল্কে পণ্য আমদানি, নথি জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে কাস্টমস আইনে আটকে যায় বিভিন্ন আমদানি পণ্য। আমদানিকারক জরিমানা গুণতে গিয়ে বাজারমূল্য থেকে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। ফলে আমদানিকারকরা এসব পণ্য খালাসে নিরুৎসাহ দেখান। এতে করে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা বাড়ে। নিয়ম মাফিক প্রতিমাসে নিলামের ব্যবস্থা করার জন্য কাস্টমকে চিঠি দেয়া হচ্ছে বলে দাবি বন্দরের। অপরদিকে একটা নির্দিষ্ট সময় ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে নিলাম কার্যক্রমে সময় লাগে বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা। পাশাপাশি চলমান ডলার সংকট নিরসনে নতুন করে আমদানি না করে আগের আমদানি করা পণ্য দ্রুত খালাস করার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনার ছিল মাত্র ১২টি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। তারপর ২০০৫ সাল থেকে পরবর্তী ৪ বছর অর্থাৎ ২০০৯ সাল পর্যন্ত নিলামযোগ্য কনটেইনার ছিল প্রায় ৪শ’টি। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯৫০টিরও বেশি নিলামযোগ্য কনটেইনার ছিল। এরপর আস্তে আস্তে বেড়ে কনটেইনারের সংখ্যা হাজারের উপর চলে যায়। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৯শ’টি নিলামযোগ্য কনটেইনারে ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০২০ সালে সব মিলিয়ে বন্দরে নিলামের অপেক্ষায় ছিল ৫ হাজার ৬৪২ টিইইউএস কনটেইনার। গতবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে এসে সে সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৭ টিইইউএস কনটেইনারে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার নিলামযোগ্য কনটেইনার পড়ে রয়েছে। এসব কনটেইনারে ৮২ হাজার টনেরও বেশি আমদানি পণ্য রয়েছে। সে সঙ্গে খোলা পণ্য রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মেট্রিকটন।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিধিমালা অনুযায়ী, জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করতে হয় আমদানিকারকদের। এই সময়সীমার মধ্যে পণ্য খালাস না করলে আমদানিকারকের কাছে পণ্যের অবস্থান জানিয়ে নোটিশ পাঠায় কাস্টমস। নোটিশ দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আমদানিকারকের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া না গেলে পণ্যগুলো নিলামে তুলতে পারে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরে এভাবেই পড়ে রয়েছে নিলামযোগ্য সাড়ে চার হাজার টিইইউএস কনটেইনার। 

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম সিভয়েসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হওয়া পণ্য সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। করোনার পর ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হয়েছে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে। সরকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সেটা কাজে লাগাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ীদের আরও বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সৎভাবে ব্যবসা করতে হবে, বৈধভাবে পণ্য আমদানি করে তা যথাসময়ে খালাসের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন আমদানিকারক পণ্য আমদানি করে কেন পণ্যগুলো নিচ্ছে না এটা খতিয়ে দেখা দরকার। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করা উচিত।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক সিভয়েসকে বলেন, পণ্য খালাস না করায় আমদানিরকারককে বার বার চিঠি দেয়ার পরও কোন সাড়া না মিললে তখনই কনটেইনার নিলামযোগ্য হয়ে পড়ে। প্রতিমাসে আমরা নিলামের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে রুটিন মাফিক চিঠি পাঠাচ্ছি। এসব কনটেইনার বন্দরের অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। পাশাপাশি এসব কনটেইনারের ভাড়াসহ অন্যান্য চার্জ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। কাস্টম থেকে যেসব পণ্য খালাস হয়, সেগুলো নিয়ে জটিলতা থাকতে পারে। তবে আমরা চাই পণ্যজট না হয়ে দ্রুত পণ্য খালাস হোক।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার (নিলাম শাখা) আলী রেজা হায়দার সিভয়েসকে বলেন, আমদানিকারক পণ্য খালাস না করলে তা নিয়মানুযায়ী নিলামে তুলে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হয়। তবে বললেই তো আর নিলামের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। নিলামের কাজগুলো কিন্তু স্বল্পমেয়াদি নয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; এতে সময় লাগে। তবে বন্দরে কনটেইনার জট কমানোর পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার লক্ষ্যে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি মাসে দু’টি করে নিলামের আয়োজন করছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমরা বেশকিছু পণ্য নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে গার্মেন্টস পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, গাড়ি ও ফল রয়েছে বলে জানান তিনি।

-সিভয়েস/টিএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়