দুর্যোগের জন্য দায়ী চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১৩ এপ্রিল ২০২৩
দুর্যোগের জন্য দায়ী চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি

আকবরশাহ থানার কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নয় নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। দুই মেয়াদে গত নয় বছর ধরে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি তিনি। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির সভাপতিও। অথচ জনপ্রতিনিধির চেয়েও ‘পাহাড়খেকো’ হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলর। এক-দুই বার নয়, পরপর চারবার হয়েছেন পাহাড় কাটার মামলার আসামি। একই মামলার আসামি তার স্ত্রীও। পাহাড় কেটে সমতল বানিয়ে প্লট বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এমনকি এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হলেও তিনি গ্রেপ্তার হননি। 

একের পর এক পাহাড় কেটে সাবাড় করেও কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে বারংবার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান তিনি। চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির পদে থেকে পাহাড় রক্ষার পরিবর্তে পাহাড় সাবাড় করার মামলায় কাউন্সিলরের সম্পৃক্ততা থাকায় বিব্রত খোদ চসিকের হর্তাকর্তারা। তবে পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করায় এবার আর ছাড় নয় বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রথম মেয়াদে ২০১৫ সালে কাউন্সিলর হওয়ার পর ওই বছরের ২৮ মে পাহাড় কাটার অভিযোগে দুটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০১৭ সালে ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই অভিযোগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের আগষ্টে ফের পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলার আসামি হন কাউন্সিলর জসিম। ওই মামলায় কাউন্সিলরের স্ত্রীসহ মোট তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি পাহাড় কাটা পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হওয়ার ঘটনায়ও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে কোনো মামলায় এখন পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার হননি। উল্টো নিজেই রয়েছেন পাহাড় রক্ষার দায়িত্বে। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল ফের পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগে কাউন্সিলর জসিমসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। 

সর্বশেষ মামলার এজহারে বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রকল্পের মাধ্যমে এবি হক ব্রাদার্সকে রাস্তা নির্মাণের অনুমতি দেয় এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাস্তা নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ১৩ হাজার ৩০০ ঘনফুট পাহাড় কাটার দায়ে চসিক কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে শুনানির নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পাহাড় কাটা বন্ধ করার জন্য অগ্রণী ব্যাংক অফিসার্স কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড লিখিত অভিযোগ দিলে আবারও শুনানিতে হাজির থাকার নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওইসময়  কাউন্সিলর জসিম শুনানিতে উপস্থিত থাকলেও চসিকের প্রকল্প পরিচালক এবং সিডিএর কোনো কর্মকর্তাই শুনানিতে আসেননি। একই পাহাড় কাটার অভিযোগে এর আগেও একজনকে গ্রেপ্তার করে প্রশাসন। 

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগে দুটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তার স্ত্রীকেও পাহাড় কাটার ঘটনায় একবার জরিমানা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মামলা করা হয়। সর্বশেষ দুইদিন আগে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।’

চসিক সূত্রে জানা যায়, আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনা এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মার্ণের বিষয়টি জানা ছিল না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সংশ্লিষ্টদের। জেলা প্রশাসনের অভিযানের পর সড়ক নিমার্ণের কাজ বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও কাউন্সিলর জসিমের নির্দেশে পুনরায় কাজ শুরু হয়। পরে পাহাড় কেটে সড়কের গাইড ওয়াল দেওয়ার সময় একজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন থেকে সাত সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একইসঙ্গে চসিকও তিন সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চসিকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাউন্সিলরের নির্দেশে পাহাড় কাটার মিছিল চলে আকবরশাহতে। চসিকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। তারপরেও বহাল তবিয়তে দায়িত্বে আছে এই কাউন্সিলর। কিন্তু কীভাবে আছে সেটার উত্তর জানা নেই আমাদের। তিনি কিনা আবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি। তার একটা গুন্ডা বাহিনীও আছে। যেটার পাওয়ার (ক্ষমতা) বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে দেখিয়েছে। এতো মামলা হওয়ার পরেও একবারের জন্য তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।’

 এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ‘আমি আসলে জানতামই না উনি (কাউন্সিলর জসিম) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এখনই জেনেছি। তাছাড়া ঘটনার সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম তাই আপনাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি আমাদের প্রকৌশলীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই বিষয়টা নিয়ে তারা (পরিবেশ অধিদপ্তর) আমাদের কিছু জানায়নি। তবে আমরাও এ ঘটনায় ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে যখন মোবাইল কোর্ট হলো তখনই আমরা জেনেছি সেখানে পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটেছে। যদিও আমাদের নথিতে ছিল সেখানে রাস্তা করা হচ্ছে। যখন জানলাম পাহাড় কেটে রাস্তা করা হচ্ছে তখনই কাজ বন্ধ করা হয়। কিন্তু এরপর আবার কখন কাজ শুরু করেছে এর কিছুই আমরা জানি না। আমরা কেউই এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির দায় করপোরেশন নিবে না। এক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স। আমাদের রুলস রেজুলেশন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এ প্রসঙ্গে জানতে কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিমকে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর বলেন, মামলাটি তদন্ত করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আটকের বিষয়টি তারাই দেখবেন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়