Cvoice24.com

‘লাগেজ পার্টি’র কাছে মার খাচ্ছে ফ্যাশন হাউস!

শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ২৮ মার্চ ২০২৪
‘লাগেজ পার্টি’র কাছে মার খাচ্ছে ফ্যাশন হাউস!

ঈদ উৎসবের আমেজেও যেন বিবর্ণ ও নিষ্প্রাণ চট্টগ্রামের ফ্যাশন হাউসগুলো। জমজমাট ব্যবসার প্রস্তুতিতেও শো-রুমে  সেভাবে বেচাকেনা নেই। তবে জম্পেশ বেচাবিক্রি চলছে অনলাইনে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাকের কারণে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেশিয় ফ্যাশন শিল্প। দেশিয় ফ্যাশন হাউজগুলোতে নানা আয়োজন থাকলেও লাগেজ পার্টির মাধ্যমে খুব সহজলভ্য হওয়ায় বিদেশি পোশাক খুব সহজলভ্য হয়েছে। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা বেশিরভাগ সেদিকেই।

তাঁদের আশা, ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে ততই জমে উঠবে। এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে দেশিয় ফ্যাশনশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক ও স্বতন্ত্র নকশার পোশাকের পসরা নিয়ে নতুনত্ব আনা হয়েছে নারী, পুরুষ আর শিশুদের পোশাকে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তরুণদের কথা চিন্তা করে এ বছর বেশিরভাগ পোশাকে আধুনিক কাট ও মিনিমাল নকশা করা হয়েছে। এছাড়া থিমভিত্তিক পোশাকও এবারের ঈদের অন্যতম আকর্ষণ। তবে বরাবরের মতোই চাহিদার শীর্ষে রয়েছে টু-পিস, থ্রি-পিস, শাড়ি-পাঞ্জাবি। 

কৃষ্টি : চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ফ্যাশনহাউস কৃষ্টি বুটিকস প্রতিবারের মত এবারও দুই ধরনের পোশাক এনেছে, যার একটি রেগুলার ও অন্যটি এক্সক্লুসিভ টু পিস। কৃষ্টি বুটিক হাউজের নান্দনিক বৈশিষ্ট্যই হলো হাতের কাজ। মসলিন শাড়ি, সিল্ক মসলিন, সিল্ক মসলিন ড্রেস, কটন শাড়ি, কটনের থ্রিপিস, টু পিসসহ বাহারি ডিজাইনের মনকাড়া ছোট-বড় নকশী কাঁথার ফোঁড়ে সব ধরনের পোশাকের সম্ভার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি হাজির হয়েছে ক্রেতাসাধারণের জন্য। 

কৃষ্টি বুটিকসের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার নূজহাত নূয়েরী কৃষ্টি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ঢাকা আর চট্টগ্রামের ক্রেতাদের রুচি ভিন্ন। দেখা যায় চট্টগ্রামের ক্রেতারা আনস্টিচ (সেলাইবিহীন) কটনের পোশাক বেশি পছন্দ করেন। আর ঢাকায় রেডিমেট পোশাক বেশি বিক্রি হয়। চাহিদার শীর্ষে থাকা টু-পিস আর রেগুলার পোশাক বেশি চলছে। সারা বছরই এমন পোশাকের চাহিদা থাকে তবে ঈদের সময় একটু বেশিই। এবার ঈদের পর পর পহেলা বৈশাখ এরপর আবার কোরবানির ঈদ। সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে পোশাক আছে কৃষ্টিতে।’ 

দেশীদশ, আড়ং : উৎসবের আমেজ তুলে ধরতে শৈল্পিক, মেঘরোদ্দুর, কে-ক্র্যাফট, রঙ বাংলাদেশ, বিশ্বরঙ, অঞ্জনস, আর্ট, সাদাকালো, দেশাল, নগরদোলা ও সৃষ্টির সমন্বিত উদ্যোগ দেশীদশ আর আড়ংয়ের পোশাকগুলোতে উজ্জ্বল রঙের পাশাপাশি প্রকৃতির বিভিন্ন রঙের ব্যবহার করা হয়েছে নান্দনিকভাবে। পাশাপাশি কাজের মাধ্যম হিসাবে এসেছে টাই-ডাই, ব্লক, বাটিক, কারচুপি, অ্যাপলিক, কাটওয়ার্ক, স্ক্রিনপ্রিন্টের পোশাকে এসেছে জয়সিল্ক, ধুপিয়ান, এন্ডিসিল্ক, হাফ সিল্ক, কটোনসহ আরামদায়ক কাপড়ের বাহার।

শৈল্পিক : প্রতিবছর ঈদ এবং পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নতুন ডিজাইনের পোষাক নিয়ে আসে ফ্যাশন ব্র্যান্ড শৈল্পিক। সব শ্রেণীপেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও তরুণদের পছন্দের শীর্ষে শৈল্পিকের পাঞ্জাবি।

শৈল্পিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচএম ইলিয়াস বলেন, ‘করোনার সময় আমাদের অনেক খারাপ সময় গিয়েছিল। এখন দিন দিন আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। আর শৈল্পিকে সবসময় পাঞ্জাবীর চাহিদা বেশি থাকে। এবারও তাই। তাছাড়া হাটিহাটি পা পা করে শৈল্পিক আজ ২০ বছরে এসেছে। ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্রেতা সাধারণের জন্য বেশ কিছু আকর্ষণীয় অফারের আয়োজন করা হয়েছে। এই আয়োজনের মধ্যে ২ হাজার টাকার পণ্য কিনলে একটি লাকি কূপন, ১০ হাজার টাকার পণ্য কিনলে ১৫ শতাংশ ডিসকাউন্টসহ আরো বেশ কিছু অফার রাখা হয়েছে।’

মেঘরোদ্দুর : মেঘরোদ্দুরের স্বত্বাধিকারী নাসরিন সরওয়ার মেঘলা বলেন,  চাহিদার শীর্ষে আছে শাড়ি। আমি যেহেতু দেশীয় কাপড় নিয়ে কাজ করি এবারও হালকা রংয়ের প্রাধান্যটা বেশি।’

বেচা বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি নাসরিন সরওয়ার মেঘলা বলেন, ‘আশা করি সবসময় যাতে ভালো বিজনেস করতে পারব সেভাবেই ইনভেস্ট করি, নানান ডিজাইনের পোশাক আনি। এখনো পর্যন্ত ঈদের কেনাকাটা সেভাবে জমে উঠেনি। মোটামুটিভাবে চলছে। ১৫ রমজান বা ২০ রমজানের পরই কেনাকাটা শুরু হবে। 

কেনাকাটা অফলাইনে কম, অনলাইনে বেশি

গত কয়েক বছরে দেশে অনলাইনে কেনাকাটার প্রচলন বেড়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে প্রায় সব ব্র্যান্ডেরই অফলাইনের (দোকান বা শোরুম) পাশাপাশি অনলাইনেও শপ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঘরে বসেই কেনাকাটা করেন ক্রেতারা। যে কারণে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটার চেয়েও ঘরে বসেই কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। এ কারণে ফ্যাশন হাউসগুলোর শোরুমের পাশাপাশি অনলাইনে বিক্রিও বেড়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত অফলাইনের চেয়েও অনলাইনে বেশি কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা— এমনটাই জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। 

এ বিষয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার নূজহাত নূয়েরী কৃষ্টি সিভয়েসকে বলেন, ‘অনলাইনে ভালো, অফলাইনে অনেক কম। আমার কাছে মনে হচ্ছে বেতন বোনাস পেলে হয়তো তখন কেনাকাটা শুরু হবে। তবে অনলাইনে ভালো সাড়া পাচ্ছি। আরেকটা বিষয় হতে পারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানুষ খুব প্যাকটিকাল হয়ে গেছে। আগের মতো প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটা করেন না। আশা করছি ১৫-১৬ রোজার পর একটা কেনাকাটা বাড়বে। তবে আমার কৃষ্টি বুটিকস হাউজের ক্ষেত্রে দেখছি মানুষ অফলাইনের চেয়েও অনলাইনে কেনাকাটা করছে।’ 

দীর্ঘদিন দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পোশাক কেনেন সরকারি চাকরিজীবী জহুরা জুহি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের পোশাক কিনতে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাউজগুলোতে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই ঈদে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাক কিনছি। যতই ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি পোশাক আসুক না কেন দেশীয় ডিজাইন করা পোশাকই আমার ভালো লাগে।’ 

করোনার পর ধস নেমেছে চট্টগ্রামের দেশীয় পোশাকের বাজারে

করোনা মহামারির কারণে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের উদ্যোক্তারা। চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তালিকাভুক্ত চট্টগ্রামের দেশীয় ফ্যাশনশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে হাজারেরও কম। যদিও করোনা পরবর্তী কেবল তিনজন নারী উদ্যোক্তাই পেয়েছেন সরকারি প্রণোদনা। এমনকি পাচ্ছেন না ঋণও। এর ফলে খাতটিতে জড়িত উদ্যোক্তারাও গুটিয়ে নিয়েছেন দীর্ঘ কয়েক বছরের ব্যবসা। 

করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে দীর্ঘ ৩০ বছরেও বেশি সময় ধরে কাজ করা দেশের প্রথম দিককার নারী উদ্যোক্তা, চট্টগ্রামের ডিজাইনার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও রওশন বুটিকসের স্বত্তাধিকারী ডিজাইনার রওশন আরা চৌধুরী সীমিত করেছেন ব্যবসায়িক কার্যক্রম। আউটলেট বন্ধ হয়ে গেলেও অনলাইনে চলছে কেনাবেচা। একইভাবে চট্টগ্রামের আরেক ফ্যাশন হাউজ মিয়াবিবিও সীমিত করে নিয়েছেন নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। 

চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার ও কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক এবং কৃষ্টি বুটিকসের স্বত্বাধিকারী নূজহাত নূয়েরী কৃষ্টি বলেন, ‘কোভিডের পর ২১-২২ সালের ঈদেও যেমন বেচাবিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে গেলো দুই বছরে আরও কমে গেছে। এবারও এখনো পর্যন্ত ঈদ কেনাকাটা জমে উঠেনি। আমরাও আগের মতো সব ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) করে ফেলি না। কোভিড থেকে একটা শিক্ষা নিয়েছিলাম। আমিও এখন সেভাবে ইনভেস্ট করছি যাতে সারাবছর টানতে পারি। নাহলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’

গতবছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গত বছর ২০ রোজার পরে বিক্রি শুরু হয়েছিল। প্রথমে তো ধরে নিয়েছিলাম যা ইনভেস্ট করেছি তার পুরোটাই জলে যাবে। যদি প্রথম থেকে বিক্রি হতো তাহলে ইনভেস্টটা পুরোটা উঠে আসতো। আবার দেখা গেছে ঢাকার চিত্র ভিন্ন। সেখানে প্রথম দিকে বিক্রি হয়েছে শেষের দিকে তেমন হয়নি। আর চট্টগ্রামে হয়েছে শেষের দিকে। 

ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাকের কারণে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন শিল্প। এমন মন্তব্য করে নূজহাত নূয়েরী বলেন, ‘যারা লাগেজ পার্টি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা পেরে উঠি না। দেখা যায় ঈদের আগ থেকেই অবৈধভাবে লাগেজে করে ভারতীয়, পাকিস্তানি পোশাক এনে অনলাইনে বিক্রি করে। ফলে দেশীয় পোশাকের বাজারে সেভাবে আমাদের লাভটা থাকে না। যার কারণে আমরা বিনিয়োগও কমিয়ে দিয়েছি, কাজও কমিয়ে দিয়েছি। আমাদেরকে ভ্যাট-টেক্স দিয়েই বিক্রি করতে হয়। আমরা দেশি পোশাকের কাজ করি। প্রত্যেকটা ম্যাটারিয়াল কিনতে হয়। কোনো জিনিসই কিন্তু সস্তা না। কাপড় সুতা বোতাম থেকে সবই ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে কিনতে হয়।’

একই মন্তব্য দেশীয় পোশাক নিয়ে কাজ করা ফ্যাশন হাউজ মেঘরোদ্দুরের স্বত্বাধিকারী নাসরিন সরওয়ার মেঘলার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশিয় কাপড়ের ম্যাটারিয়ালগুলো সহজলভ্য না। আমরা যারা দেশীয় শিল্প নিয়ে কাজ করছি তাদেরকে বেশি দাম দিয়ে ম্যাটারিয়াল কিনতে হয়। আবার সব ম্যাটারিয়াল মার্কেটে পাওয়াও যায় না। যার কারণে আমাদের ব্যয় বেড়ে যায়। এখন মানুষ ভাবে কেন আমরা বেশি দাম দিয়ে দেশীয় জিনিস কিনবো, এই দামেই অন্য কাপড় পেয়ে যাবো! আর এ কারণেই কিন্তু আমরা মার খেয়ে যাচ্ছি। ভারতীয় বা পাকিস্তানি পোশাকের কারণে আমরা যারা বুটিকস হাউজের সঙ্গে জড়িত তাদেরই টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

করোনা পরবর্তী ধাক্কা সামাল দিয়ে উঠতে পারেননি মন্তব্য করে চট্টগ্রামের ডিজাইনার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রওশন আরা চৌধুরী বলেন, ‘করোনার কারণে এবং অসুস্থতার কারণে ব্যবসায় ছোট করে আনতে হয়েছে। আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় যেহেতু এ শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শত সমস্যার ভেতরেও কোনোভাবে টিকে আছি। এর আগে ২০১৭ সালের বন্যায় কোটি টাকার পণ্য ক্ষতি হয়েছে। এরপর এলো করোনা। তারপরেই মারাত্মক অসুখে পড়ে গেলাম। আউটলেট বন্ধ করলেও অনলাইনে সক্রিয় আছি। তবে কার্যক্রমটা সীমিত আকারে চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন একজন নারী উদ্যোক্তাকে ব্যাংক লোন পেতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তি তো আছেই। এমনকি এ শিল্পের জন্য সরকারের দিক থেকে নেই কোনো নীতিমালা বা দিকনির্দেশনা। তাই এ খাতে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক উদ্যোগ নিলে ব্র্যান্ডগুলো আরও ভালো করবে।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়