Cvoice24.com

তারুণ্যের উচ্চশিক্ষা

প্রকাশিত: ১০:২৩, ৮ মে ২০১৮
তারুণ্যের উচ্চশিক্ষা

শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হয় না। এটি আমরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করি। এ কারণেই শিক্ষাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিচার-বিবেচনা করা হয়। তাই দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি যে জনগণ, তাদের জন্য এই অধিকারটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সংবিধানেও স্বীকৃতি পেয়েছে।

শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কখনই সম্ভবপর হয় না। এটি আমরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করি। এ কারণেই শিক্ষাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিচার-বিবেচনা করা হয়। এ জন্যই দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি যে জনগণ তাদের এ অধিকারটি তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষার সর্বজনীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা তাই রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি দায়িত্ব। কোনো রাষ্ট্র যদি তা নিশ্চিত করতে না পারে তবে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বই কিছুই নয়।
কিন্তু রাষ্ট্র তো আর নিজে নিজে চলে না। তাকে চালায় সরকার নামক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আর সে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে একটি ন্যায়ভিত্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও বিশ্বচ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে তার সমাজকাঠামো গড়ে তোলা। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন হচ্ছে তরুণসমাজকে আধুনিক মন ও মননে তৈরি করা। কিন্তু সে জন্য শিক্ষার বিকল্প কিছু কি আছে? শিক্ষা ছাড়া কি সমাজ পরিবর্তন বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন করা সম্ভব? নাকি যেনতেন প্রকারে শুধু উন্নয়ন করলেই তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য টেকসই হয়?
 
 টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় উন্নয়নব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। তাহলে জনগণই তাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারে। ফলে উন্নয়নের পারদ যেমন ধারাবাহিকভাবে ওপরের দিকে উঠতে থাকে তেমনিভাবে তা টেকসইও হয়। এতে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়ে। আক্ষরিক অর্থেই তখন কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলতে আমরা যা বুঝি তা গড়ে তোলাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মাধ্যমে সে লক্ষ্য আর্জনে সক্ষম হব বলে আমরা সবাই বিশ্বাস করি।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্র নিজেই এখন ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে চাইছে। শিক্ষা নিয়ে তাদের অবস্থান এখন কাবুলিওয়ালাদের মতো হয়ে উঠছে। কাবুলিওয়ালারা পণ্য ফেরি করত। রাষ্ট্র এখন শিক্ষার ফেরিওয়ালা হতে চাইছে। নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হয়ে ওঠার পরই যেন তাদের চোখে আরো ব্যবসাচিন্তা ভর করেছে। ফলে রাজস্ব আহরণের দিকে তাদের মনোযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নিশ্চয়ই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছতে হলে আমাদের নিজেদের অর্থ নিজেদেরই জোগান দেয়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে। সে জন্য ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতা বাড়াতে হবে। সক্ষম সব মানুষকে আয়কর দিতে উৎসাহিত করতে হবে। এটা আমরা সবাই স্বীকার করি যে, অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানো ছাড়া দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় না। ফলে সরকার সেদিকে মনোযোগ দিক। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ ছাড়া সরকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করুক যেন বিনিয়োগ বাড়ে। সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন হোক_ তা আমরা সবাই চাই।

কিন্তু তাই বলে শিক্ষার মতো মৌলিক যে উপাদান সেখানেও ভ্যাট বসাতে হবে? ভ্যাট তো এতদিন জানতাম পণ্যের ওপরে বসে। এখন ৭.৫% হারে সেটা বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজগুলোর ওপর বসানো হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল যে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠরত তরুণ প্রজন্মের অব্যাহত দাবির মুখে সেটা প্রত্যাহার করা হবে। ঠিক এমন একটা যৌক্তিক আন্দোলনের মুখেও অর্থমন্ত্রী অনেকটা খেপে গিয়ে বলেছেন যে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে না। বেশ কয়েক বছর আগে কোচিং সেন্টারও ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ভ্যাট বসানো হলো এতে কার উপকার হবে? সরকার কি সত্যিই শিক্ষার্থীদের দেয়া ৭.৫% ভ্যাট তার কোষাগারে জমা করতে পারবে?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ২০০৬-০৭ সালে কোচিং সেন্টারের ওপর বসানো ভ্যাটের সুলুক সন্ধান করতে হবে। যতদূর জানি, সে সময় কোচিং সেন্টারগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ভ্যাটের নাম করে অতিরিক্ত অর্থ নিলেও তার সবটুকু রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়নি। ফলে কোচিং সেন্টারগুলো দুই ভাবে লাভ করল। ফির পরে ভ্যাটের নামে দেয়া উপরি টাকাও কামাই করল। তাহলে শেষ বিচারে লাভ কি সরকারের হলো? নাকি কোচিং সেন্টারের? এভাবে কোচিং ব্যবসা থেকে সরকারের টাকা কামানোর ধান্দায় প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর বাবা-মায়েরা। এমনিতে কোচিং সেন্টারগুলোর নামে বিস্তর অভিযোগ। সরকারের উচিত ছিল তাই স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পর্যায় পর্যন্ত কোচিং সেন্টার ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার উপায় খুঁজে বের করা। পাঠদানসহ ভর্তি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে বা অন্য কোনো উপায়ে সেটা করা যেতে পারত। তা না করে সেটাকে ভ্যাটের আওতায় এনে অভিভাবকদের পকেট কেটে নেয়াটা যে কতটা অযৌক্তিক ছিল তা কি এখন আর বলার দরকার আছে?

একদিকে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে শিক্ষাকে পণ্যে পুঁজি করে সরকার নিজেই ব্যবসায় নেমে পড়েছে। এটা ঠিক, এমনিতেই বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় খরচ অনেক। তার ওপর অনেক প্রতিষ্ঠান টাকা নেয়, কিন্তু মানসম্মত শিক্ষাটাও প্রদান করে না। এতে শিক্ষার যে আসল উদ্দেশ্য আলোকিত মানুষ গড়া, তা যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনিভাবে তরুণ প্রজন্ম মানহীন শিক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট-সর্বস্ব বেকারে পরিণত হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের ওপর আলগা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম হতাশায় ভুগছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। যেখানে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা নেয়া উচিত ছিল তা না করে রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার ফিকির করল। শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল। কাজটা কতটা যৌক্তিক হলো সে প্রশ্ন তাই করাই যায়।

অনেকে মনে করেন যে, বেসরকারি পর্যায়ে যারা পড়ালেখা করে তারা মনে হয় সবাই ধনী পরিবারের সন্তান। আমাদের অর্থমন্ত্রীও মনে হয় তেমনটাই জানেন। বাস্তবে বিষয়টা এখন আর কিন্তু তেমন নয়। এখন অনেক মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। প্রত্যেক বাবা-মা চান যেন তার সন্তান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। ফলে অনেক কষ্ট করে হলেও তারা তাদের সন্তানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে বাধ্য হন। কারণ দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করানোর মতো টাকা তাদের নেই। ফলে দেশে যদি সুযোগ থাকে তাহলে সে সুযোগ কেন তারা নেবেন না? সুযোগ নেয়াটা কি অপরাধ? নাকি সুযোগটাকে কঠিন করে তোলাটা অপরাধ? তাই যদি বোঝার ওপর শাকের অাঁটি হয়ে ভ্যাট বসে শিক্ষার ওপর তাহলে তারা যাবেন কোথায়? যারা বড়লোক তাদের হয়তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মরতি মরণ ওইসব মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানগুলোর কী হবে? তবে কি ধরে নিতে হবে, রাষ্ট্র মনে করছে যে, গরিব পরিবারের সন্তানরা যদি সরকারি পর্যায়ে পড়ার সুযোগ না পায় তাহলে তাদের আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই? তাহলে তাদের করণীয়টা কী? এ ব্যাপারে অবশ্যই সরকারকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বলতে হবে।

'ফেলো কড়ি মাখো তেল'_ এ আপ্তবাক্য কি সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সত্যে পরিণত করার পণ করেছে? হাবভাবে তো তা-ই মনে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় যেখানে তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; সেখানে তাদের কাছে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে তাদের উচ্চশিক্ষার পথকে সংকুচিত করে দেয়াটা আর যাই হোক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। কারণ, তরুণ প্রজন্ম চায় রাষ্ট্র সব সময় তাদের পাশে থাকুক। তাদের অগ্রযাত্রার পথকে কঠিন নয়; বরং আরো সহজ করে তুলুক। তাহলে তরুণ প্রজন্মের কাছে রাষ্ট্রের যে ছবি ফুটে উঠবে তা দেশপ্রেমের বাতিঘর হয়ে চিরজাগ্রত থাকবে। কিন্তু শিক্ষাকে পণ্য জ্ঞানে ভ্যাট আরোপ করলে তরুণ প্রজন্মের মনে রাষ্ট্রের প্রতি একটা বিরোধপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। এমন হলে তা কখনই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তাই শিক্ষার ওপর থেকে ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার হোক। তরুণ প্রজন্মের মুখে হাসি ফুটুক। সামনের দিনে তাদের মধ্য থেকে গরিববান্ধব সুযোগ্য ও সুশিক্ষিত নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হোক। দেশ সামনের পানে এগিয়ে যাক।
আমরা চাই এমন সুশিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠুক যারা দেশকে হৃদয়ে ধারণ করে সামনের কাতারে থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। দেশের সমস্যা এবং সম্ভাবনার জায়গা নিয়ে ভাববে। তারা সব সময় দেশের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে এক করে দেখুক। তাহলেই সামনের দিনগুলোয় সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশপ্রেমের আলোয় আলোকিত যে তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠবে তাদের হাত ধরে দেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন হবে। এভাবে সম্ভাবনার বাংলাদেশ বাস্তব হয়ে ধরা দিক সেটাই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।

সিভয়েস/এএইচ

90

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়