Cvoice24.com


স্বাগত 2021, মানুষ নিঃশ্বাস নিক প্রাণভরে

প্রকাশিত: ১৯:৪০, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
স্বাগত 2021, মানুষ নিঃশ্বাস নিক প্রাণভরে

ছবি: সিভয়েস

পুরাতনের গ্লানি ভুলে নতুনকে স্বাগত জানানোই কালের নিয়ম। তবে বিষিয়ে তোলা বিশটাকে পার করতে পারলেই যেন বাঁচে বিশ্ববাসী, তেমনটা সচারাচর চোখে পড়ে না। বছরভর করোনার প্রকোপ। একের পর এক মৃত্যুর মিছিল, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা, হতাশা— সব গ্লানি ভুলেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নতুনকে বরণ করে নেয় ক্লান্ত শ্রান্ত চরম বিপর্যস্ত পৃথিবী।  

গোটাবিশ্বকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করেই বিদায় নিয়েছে ২০২০। আর নতুন শতাব্দীর দুদশক পূর্ণ হয়ে তৃতীয় দশকে পা রাখলাম আমরা। নতুন বছরে তাই একটিই চাওয়া— দুর্বিষহ নানা ঘটনা থেকে মুক্ত হোক বিশ্ব। প্রতিটি মানুষ নিঃশ্বাস নিক প্রাণভরে। আবারও সবাই মেতে উঠুক সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে, বৈরী সময়কে মাড়িয়ে হেসে গেয়ে উঠুক জীবনের জয়গান। 

কবির ভাষায় তাই বলতে হয়— ‘বেঁচে থাকাটাই এক বিস্ময়কর ২০২০!/কিছু দুঃখ গ্লানি মুছে যাক— নতুন দিন/বদলের ২০২১! আরেটুকু বেঁচে থাকি/দুরাশা নয় স্বপ্নময়— এক সবুজ পৃথিবী/ঘিরা লয়; তবুও ক্ষণ আসে— ক্ষণ যায়/দূরদেশে কোন অজানা ঠিকানায়! হিতকর/কর্ম সাধন— যুগ যুগান্তর হয়ে থাক উজ্জ্বল।’

এদিকে করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে সবাইকে খ্রিস্টীয় নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভাইরাস আতঙ্কের ২০২০ পেরিয়ে ২০২১ সালে মহামারী মোকাবেলার লড়াইয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, ‘নববর্ষ সকলের মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। মহামারীর ভয়াবহতাকে মোকাবেলা করে নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ— নববর্ষে এ প্রত্যাশা করি।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘প্রতি বছর নববর্ষকে বরণ করতে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বর্ণাঢ্য নানা আয়োজন করা হলেও করোনা মহামারীর ফলে এবার উৎসবের আমেজ অনেকটাই ম্লান।’ তিনি দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নববর্ষ উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘২০২১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর একটা যুগসন্ধিক্ষণ হচ্ছে ২০২১। এই যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনে আমাদের নিরলস প্রয়াস চালাতে হবে।’

খ্রিস্টীয় নতুন বছরের শুভেচ্ছা বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নতুন বছরে আমরা একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। করোনা মহামারী বিশ্ববাসীকে এক কঠিন বার্তা দিয়েছে। যতই উন্নত হোক না কেন, একা কোনো দেশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’

মহামারী মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই যে কোনো বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব। আমাদের সকলকে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০২০ খ্রিস্টাব্দ বাঙালি জাতির জীবনে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কেননা, ১০০ বছর পূর্বে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা এক ছোট্ট খোকা কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার সারাজীবনের আত্মত্যাগ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদণ্ডে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। মহামারীকালেও দেশ ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছর। ৯৭.৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। প্রথম বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রূপকল্প-২০২১ অর্জন প্রায় শেষ।’

আমরা সব সময় বলি— সময় ও স্রোত সব অবস্থাতেই বহমান। কোনো পরিস্থিতিতেই থামিয়ে রাখা যায় না। জীবনটাও ঠিক তেমনই সতত চলমান। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বাবস্থায় অনুভব করা যায় এর স্পন্দন। তবে বর্তমান সময়টা মানবসভ্যতার জন্য ঘোরতর ক্রান্তিকাল। একটি বছরের শুরুতে যে করোনা বিশ্ব মহামারীর চোখরাঙানিতে মানুষের বন্দী জীবনের শুরু, তা নতুন আরেকটি বছরে পদার্পণ করছে। 

করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। কেড়ে নিয়েছে প্রায় ১৮ লাখ জীবন। কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা, আনন্দ-বেদনার কত কিছু ঝরে গেছে মৃত্যুর শীতল ছোঁয়ায়। স্বজনের চোখের জলে ভেসে গেছে সব স্বপ্ন। যার সব ছিল, সে এখন নিঃস্ব। প্রিয়জনকে শেষবার দেখার সুযোগও পাননি অনেকে। এর মধ্যে করোনা কেড়ে নিয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সব আয়োজন। কাটছাঁট করতে হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানও। 

করোনা বোঝে না হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান। বোঝে না নারী-পুরুষ, শ্রেণি বিভাজন। তাই বিদায়ী বছরে কেড়ে নিয়েছে মুসলমানদের ধর্মীয় দুই উৎসব— ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আনন্দ; হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা; খ্রিষ্টানদের বড়দিনের উৎসব।

আগামীকে স্বাগত জানাতে একটু পেছনেও তাকাতে হয়। নতুন পথে পা বাড়ানোর জন্য শুধরে নিতে হয় ভুলভ্রান্তি। অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার খাতা খুলে দেখতে হয় আগামীতে প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে। কিন্তু ২০২০ সালের হিসাবের খাতা যে প্রায় সবারই শূন্য। কারো আনন্দ নেই, সুখ নেই, প্রাপ্তি নেই। প্রায় সবাই কেউ না কেউ একান্ত কাছের-দূরের স্বজন, প্রিয়জন হারিয়েছে। কেউবা হারিয়েছে বাবা-মা। কেউ স্ত্রী হারিয়েছেন, কেউ স্বামী। বিশ্বজুড়েই শোক আর হাহাকার। 

দেশ হারিয়েছে অনেক গুণী মানুষকে, যারা ছিলেন অত্যন্ত মানবিক। মানুষকে ভালোবাসতেন। দুঃসময়ে-সংকটে মানুষের জন্য ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়াতেন। দিকহারা মানুষকে দিশা দেখাতেন। তাই এবার কেউ আর পেছনে তাকাতে চাইবে না। প্রত্যাশার সামনেই তাকাবে এবং গাইবে নতুন বছরের আলোর গান, ফসলের গান, প্রাপ্তির গান। তবে করোনা নিয়ে ২০২১ সালকেও নিরাপদ বলা যাচ্ছে না। ব্রিটেনে ভাইরাসটির নতুন স্ট্রেন পাওয়ার পর আশঙ্কার মেঘ পুরো বিশ্বজুড়েই ঘনাচ্ছে।

করোনা ছাড়াও ২০২০ সালে বাংলাদেশ-ভারত দেখেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডব। বিশ্ব দেখেছে বৈরুত বিস্ফোরণ। ৪ অগাস্ট রাসায়নিক পদার্থের এক গুদামে ওই বিস্ফোরণে প্রাণ হারান দুশর বেশি মানুষ। আহত হন ৬ হাজারেরও বেশি। মার্কিন পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর জের ধরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরেও ছিল নজিরবিহীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভাজন, তিক্ততা ও নোংরামি। পূর্ব ইউরোপে দক্ষিণ ককেশাসের বিরোধপূর্ণ এলাকা ঘিরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বেজেছিল যুদ্ধের দামামা। আলোচনায় ছিল ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কৃষক আন্দোলন। লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় হয়েছে ভারত-চীন সংঘর্ষ। 

বছর শেষে কিছুটা আশার আলো অবশ্য দেখিয়েছে অচিরেই করোনা ভ্যাকসিন মেলার সুখবর। এখন প্রত্যাশা সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে দ্রুত ভ্যাকসিনেশন দেওয়া শুরু এবং শেষ হোক। মানুষ বাঁচুক। শিক্ষার অচলাবস্থা কাটুক। দেশের অর্থনীতি সচল হয়ে উঠুক আবার। কলকারখানা-কৃষি উৎপাদন চালু হোক ব্যাপকহারে। বেকারত্ব দূর হোক। পুনরুজ্জীবিত হোক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কুড়িতেই শেষ হোক করোনার বিষজ্বালা, নতুন বছর সফল হোক, শুভ হোক সবার। আনন্দে ভরে উঠুক বিশ্বভুবন।

এদিকে বিশ্বে সবার আগে ইংরেজি ২০২১ সালকে স্বাগত জানায় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ সামোয়া। গ্রিনিচ মান সময় ১০টায় রাজধানী আপিয়াতে আতশবাজি রোশনাইতে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। এর পর একে একে স্বাগত জানায় পুরো বিশ্বই। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার বাঁধ ভেঙেই গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে চট্টগ্রামের ছাদে ছাদে শুরু হয় আতশবাজী। একঘেঁয়ে জীবন ঠেলে পরিবার নিয়ে উৎসবে মেতেছেন অনেকেই। গোধুলী লগ্নে বছরের শেষ সূর্যাস্তকে বিদায় এবং বছরের শেষ রাত উদযাপন করতে পতেঙ্গা ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেও গেছেন হাজার হাজার পর্যটক। মধ্যরাত পেরিয়ে যে সূর্যের দেখা মিলবে নতুন বছরের সেই সূর্যকেও স্বাগত জানাবেন তারা। আর ওই ঊষার আলোয় ভর করেই আসবে নতুন দিনের স্বপ্ন।

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়