Cvoice24.com

ব্যবসায়ীদের আশা
বেতন-বোনাস হলেই নামবে ক্রেতার ঢল

মিনহাজ মুহী, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৭:০৫, ২৪ মার্চ ২০২৪
বেতন-বোনাস হলেই নামবে ক্রেতার ঢল

‘১৩ রোজা, মাসের ২৪ তারিখ। এখনো অনেকের বেতন বোনাস হয়নি। বেতন বোনাস পেলেই জমে উঠবে ঈদের বাজার।’— ক্রেতার আনাগোনা কম প্রসঙ্গে বলছিলেন চট্টগ্রাম জহুর হকার্স মার্কেটের বেস্ট ওয়ান নামে পাঞ্জাবির দোকানের মালিক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত বেচাকেনা কম বলেও জানালেন তিনি। 

‘গরিবের মার্কেট’ খ্যাত ওই মার্কেটে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না প্রতিবছর ঈদবাজারে। লালদীঘির পশ্চিম প্রান্তে মূল ফটক থেকে নিউমার্কেট প্রান্ত— কদম ফেলার জায়গা থাকে না। সেখানে এ বছর সব অলিগলি প্রায় ক্রেতাশূণ্য!

শনিবার (২৩ মার্চ) সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অন্যবার ক্রেতার ভিড়ে তিল পরিমাণ ঠাঁই না থাকা এ মার্কেটের চিত্র এবার ব্যতিক্রম। এবার ১২ রমজানের পরও ক্রেতাদের ভিড় নেই। ক্রেতাদের আনাগোনা কম থাকায় প্রায় সব দোকানেই ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দোকানির কর্মচারী সবাই অলস সময় পার করছেন। অনেকে তাদের নিজস্ব মোবাইলে গেমস খেলছেন। আবার কয়েকজন মিলে মোবাইলে খেলছেন লুডু। 

লুৎফর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই সময়ে মার্কেটে সব থেকে বেশি ভিড় থাকার কথা ছিল। সারা বছর যে রকম ব্যবসা হয় তার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা ছিল ঈদকে ঘিরে। কিন্তু এবার অন্যান্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম। দামি পোশাক তুলেও ক্রেতাদের আনাগোনা কম থাকায় অলস সময় পার করছি।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেচাবিক্রি এখনও জমে ওঠেনি। এবার ১২ রমজান পার হলেও ক্রেতাদের আনাগোনা কম। অনেকেই অফিসে চাকরি করেন। তাদের এখনও বেতন বোনাস হয়নি। সামনের মাস ঢুকতেই চাকরিজীবীদের বেতন বোনাস হয়ে যাবে। তখন ক্রেতাদের ভিড় বাড়বে মার্কেটে। তাই আশা রাখছি, ঈদের আগে আগেই বেচাকেনা বাড়বে। আর ব্যবসায়ীরাও তাদের বিক্রির পোশাক ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবেন।

বেস্ট ওয়ান নামে পাঞ্জাবির দোকানের মালিক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ বছর বেচাকেনা খুব ঠাণ্ডা। মানুষের আনাগোনা নেই। গত বছর এমন দিনে অনেক পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছিল। এবার ১২ রমজান চলে গেলেও যা পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে তা খুবই নগন্য। আশা করছি, আর কয়েকদিন পর থেকে বেচাবিক্রি বাড়বে।’ 

পাঞ্জাবির দামের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দোকানে ৬শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার ২শ’ টাকায় মিলছে বড়দের পাঞ্জাবি। আর ছোটদের পাঞ্জবি রয়েছে ৪শ’ থেকে ১ হাজার ৩শ’ টাকার মধ্যে।’

দীর্ঘ ৫ বছর বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন ফরহাদ হোসেন। তার চোখে এবারের মার্কেটের চিত্র ব্যতিক্রম। অন্যান্যবার এমন দিনে ঈদকে ঘিরে মার্কেটে মানুষের ভিড় থাকতো। বেচাবিক্রি চলতো হরদম। যার কারণে দম ফেলার ফুসরত পেত না। অথচ এ বছর সব থেকে বিক্রি কম হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘দোকানে চাকরিজীবনে এ বছরই প্রথম দেখছি বিক্রির অবস্থা এতটা খারাপ। করোনার পরের বছরও এমন সময়ে দৈনিক পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে মিনিমাম ২৫-৩৫ হাজার টাকা। এবার সেই বিক্রি ১০ হাজারেও যায়নি। তবে এবারের বেচাকেনা কেবল যে আমাদের দোকানের খারাপ যাচ্ছে তা-ই নয়, পুরো মার্কেটের অবস্থা এমন।’

কয়েকজন বিক্রয়কর্মী জানান, অন্য বছরের হিসাবে এবার বিক্রি কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশের মতো। তবে তাদের আশা ১৫ রমজানের পর থেকেই বাড়বে বেচাকেনা।

ভিড় এড়াতে আগেভাগে মার্কেটে অনেকে

চট্টগ্রাম নগরে রিকশা চালান মোহাম্মদ হারুন। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চালাতে হয় তাঁর। এক মেয়ে ও এক ছেলের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন ‘গরিবের মার্কেট’ খ্যাত জহুর হকার্স মার্কেটে। মার্কেটের ২ নম্বর গলির একটি দোকানে সন্তানদের জন্য পোশাক দেখার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ঘরে আমরা চার সদস্য। আমি আর আমার স্ত্রীর জন্য কাপড় না নিলেও ছেলে-মেয়েদের জন্য নিতে হয়। তারা এখনও ছোট। ঈদের কাপড়ের জন্য বায়না ধরেছে। রমজানের আগে রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম। সেগুলো নিয়ে তাদের জন্য জামা কিনতে এসেছি। এখন প্রথম দিকে হওয়াতে মানুষের ভিড় কম থাকবে। আর দামেও একটু সস্তা পাব। তাই আজ চলে এসেছি।’

তিনি আরও বলেন,  ‘তবে যেভাবে রমজান ছাড়া অন্য সময়ে ভিড় থাকে। এখন সেই ভিড় নেই। অন্য সময় এখানে হাঁটতেও কষ্ট হয়।’

সোহরাব হোসেন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘মনে করেছি অন্যান্য সময়ের মতো মার্কেটে প্রচণ্ড ভিড় থাকবে। তবে এসে দেখছি লোকজন খুবই কম। আগে তো হাঁটতেও কষ্ট হতো। মনে হতো, মার্কেটের গলিতে ঢুকে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে হবে মানুষের জো তে সামনের দিকে চলে যাব। আর এখন ঈদকে ঘিরেও মানুষের সেই আমেজ এখন নেই।’

গরিবের মার্কেটে তিন ক্যাটাগরির দোকান

চট্টগ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা জহুর হকার্স মার্কেট। মার্কেটে তিন ক্যাটাগরির দোকান। এর মধ্যে কিছু দোকানে পাওয়া যায় দেশিয় পোশাক কারখানা থেকে সংগ্রহ করা রপ্তানিযোগ্য পোশাক সামগ্রী। এসবের পোশাকের দামে বেশি হলেও নামকরা শপিং মলের চেয়ে কম দামে মিলে এখানে। যেখানে নামি দামি শপিং মলে এসব পোশাক ২ হাজার টাকার চেয়ে বেশি; এখানে সেগুলো এক হাজার থেকে ১৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। 

আরেক ক্যাটাগরির মধ্যে কিছু দোকানে ভালো ও মাঝারি মানের মিশ্র মালামাল রয়েছে। যেসব দোকানে ভিড় করেন মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তবে পোশাকের দাম কম হওয়ায় ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেনাকাটা করেন ক্রেতারা। 

এছাড়াও রয়েছে খোলা ফুটপাতের দোকানগুলো। এসব দোকানে অতি অল্প দামে পাওয়া যায় বাছাইবিহীন ও গড়পড়তা পোশাক সামগ্রী। তবে অনেকে খুঁজে খুঁজে বের করেন নানা ডিজাইনের ভালো পোশাক। যা মিলে ৫০, ১০০ ও ১৫০ টাকার নির্ধারিত মূল্যে। 

দর্জিপাড়ায় নেই চিরচেনা ব্যস্ততা

‘সাধারণ সময়েও অনেক ভালো কাজ পাই। আর এখন ঈদকে ঘিরে যেখানে ভালো কাজ পাওয়ার কথা সেখানে তার উল্টো চিত্র। যা আসছে তাও হাতেগোনা।’ —বলছিলেন সেলাই কারিগর মোহাম্মদ রুবেল।

তিনি বলেন, ‘১৪ বছর ধরে জহুর হকার্স মার্কেটের এই গলিতে দর্জির কাজ করছি। এমন কখনও দেখিনি। করোনার পরের বছরও ভালো ইনকাম হয়েছে। এছাড়া আমাদের নরমাল দিনেও ভালো ইনকাম হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নরমাল দিনে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকি। আর ঈদকে ঘিরে রমজানে তা দ্বিগুণ হয়; অনেক সময় তা আরো বেড়ে যায়। অথচ এ বছর ১২ রমজান শেষ হলে তেমন একটা আয় হয়নি। দৈনিক ৩শ’ টাকা করেও এখন ভাগে জুটছে না।’ 

শুধু রুবেল নন; ওই গলির কমবেশি প্রায় সব দর্জি পার করছেন অলস সময়। কয়েকজনের হাতে কাজ থাকলেও তা ঘণ্টাখানেকের।

জানা গেছে, ওই গলিতে প্রায় ৫০ জন দর্জি কাজ করেন। যাদের মধ্যে অনেকে ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে সেখানে কাজ করছেন। আর তারা সবাই ছেলেদের শার্ট থেকে শুরু করে প্যান্ট, পাঞ্জাবিসহ নানা পোশাক ছোট ও ফিটিংসের কাজ করেন। আর তার বিনিময়ে কাটার ধরন হিসাব করে টাকা চান তারা।

এখন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন তারা। তবে ১৫ রমজানের পর থেকে সময় আরো বাড়বে। শেষ রমজানের দিকে সেহরির আগ পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন তারা। 

প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশে পরীর পাহাড়ের পাদদেশে ঐতিহ্যবাহী মার্কেটটির গোড়া পত্তন হয়। তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের শ্রমমন্ত্রী বিশিষ্ট শ্রমিকনেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর নামে এর নামকরণ হয় ‘জহুর হকার্স মার্কেট। শুরুতে মাত্র ৮টি দোকান নিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে বর্তমান দোকান সংখ্যা ৮২১টি। একসময় এটি ‘গরিবের মার্কেট’ এবং ‘টাল কোম্পানি’র মার্কেট হিসেবে পরিচিতি ছিল। কারণ এখানে শুধু বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পুরাতন কাপড় বিক্রি হতো।

আর এসব কাপড়ের ক্রেতারা ছিলেন বেশির ভাগ নিম্মবিত্ত শ্রেণির লোকজন। তাই অনেকে বলতেন ‘গরিবের মার্কেট’। আর কাপড়গুলো মাটিতে বড় বড় স্তুপ করে বিক্রি করা হতো বলে এটি ‘টাল কোম্পানি’র মার্কেট নামেও পরিচিতি পায়। কিন্তু এখন আর আগের মতো পুরাতন কাপড় বিক্রি হয় না, মাটিতে স্তুপ করে কাপড়ও রাখা হয় না। প্রতিটি দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন ডিজাইনের দেশি-বিদেশি নতুন পোশাক। এখানে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মিলে পরিবারের সবার পোশাক।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়