এখনো তামাকমুক্ত হয়নি হালদা

মো. হাবিবুর রহমান, রাউজান

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ৩১ মে ২০২১
এখনো তামাকমুক্ত হয়নি হালদা

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর উৎসমুখে এক সময় শত শত একর জমিতে তামাক চাষ হতো। প্রায় একযুগ আগে থেকে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, মানিকছড়িসহ পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে নদীটির দুই তীরে তামাক চাষে নিয়োজিত ছিল প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাকচাষ হয় সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। তামাক চাষে স্বাভাবিক কৃষি কাজের চেয়ে ১০ গুন বেশি কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তামাক পাকলে পচে যায়। মরাগাছ পরিচর্যার পর জমিতে পড়ে থাকে তামাকপাতা। এসব পচে বৃষ্টির সময় বিষাক্ত পানি হালদা নদীতে পড়লে পানি দূষিত হয়, মাছের খাদ্য, নদীর অন্যান্য প্রাণী মাছ মারা যায়। 

গবেষণা বলছে, তামাকপাতা স্বাভাবিক পুকুরের পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বিষক্রিয়া হয়ে মাছ মারা যায়। আর এই বিষে ভরা তামাকের নির্যাস ও চাষে ব্যবহৃত সার এবং রাসায়নিক মিশ্রিত পানি সরাসরি গিয়ে পড়তো নদীতে। এতে দূষিত হতো হালদা নদী। হালদা বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিস্টদের নজরে আসার পর বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। এতে ক্রমান্বয়ে কমে আসছে হালদা পাড়ের তামাক চাষ। হালদা নদীর উজার মানিকছড়িতে শতাধিক তামাক চাষী পরিবারকে বিকল্প জীবিকায়নে সহায়তা অংশ হিসেবে সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে পল্লী কর্ম-সহায়তা ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)’র সহযোগিতায় কাজ করে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। বিভিন্ন সময়ে হালদা পাড়ে শতাধিক তামাক চাষীর বিকল্প জীবিকায়নে সহায়তার অংশ হিসেবে কয়েক শত কৃষক-কৃষাণীর মাঝে উন্নত প্রজাতির চারা বিতরণ করা হয়। মূলধারার কৃষিতে ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা। তিন শতাধিক কৃষক-কৃষাণী তাদের পেশা পরিবর্তন করে বর্তমানে শাক-সবজি উৎপাদন করলেও শতভাগ তামাকচাষমুক্ত হয়নি। এরপরও ক্রমান্বয়ে তামাকচাষ হ্রাস পাওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে হাতেগুনা কয়েকজন এখনো নদীর পাড়ে তামাকচাষে নিয়োজিত রয়েছেন। 

মানিকছড়ি উপজেলায় কর্মরত আইডিএফ’র জুনিয়র কৃষি কর্মকর্তা থুই অং প্রু মারমা বলেন, হালদা পাড়কে তামাকচাষমুক্ত করতে আমরা কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য হালদাকে শতভাগ তামাকচাষ করা। আমরা সচেতনতার পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায়নে গাছের চারা বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছি। এরপরও মানিকছড়ি উপজেলার ২ নম্বর বাটনাতলি ইউনিয়ন ও ৩ নম্বর যোগ্যছোলা ইউনিয়নে রহালদা নদীর পাড়ে মাত্র ৩-৪জন কৃষক তামাক চাষ করেন। প্রত্যেকে গড়ে ৩ কানি জমিতে তামাক চাষ করেন বলেও জানান তিনি। 

এ প্রসঙ্গে মানিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান বলেন, এক সময় মানিকছড়িতে প্রচুর পরিমাণ জমিতে তামাকচাষ হতো। ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। চলতি অর্থ বছরের কি পরিমাণ জমিতে তামাকচাষ হয়েছে- এর তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। মানিকছড়িতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। এর আগে ২০১৯-১৯ অর্থ বছরে তামাকচাষ হতো ৩ হেক্টর জমিতে। হালদা নদীকে শতভাগ তামাকচাষমুক্ত করতে আমরা কাজ করছি। আইডিএফ আমাদের সহযোগিতা করছে।  

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ২০১৬ সালে যখন মা মাছ ডিম ছাড়েনি তখন কারণ অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হই মানিকছড়ির তামাক চাষ সম্পর্কে। তখন ক্যান্সারের মতো রূপ নিচ্ছিল তামাক চাষ। পরে আমরা এটা নিয়ে আত্মসামাজিক গবেষণা শুরু করেছিলাম। আমাদের গবেষণায় আইডিএফ ও পিকেএসএফগ্রহণ করে। তামাক চাষীদের তালিকা তৈরি করে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করি। বিকল্প জীবিকায়নে অনুপ্রাণিত করার সময় কৃষকদের উপার্জন বন্ধ হবে এমন অভিযোগ এনে একটি চক্র আমাদের বিরুদ্ধে ভুল বুঝিয়ে দিলে তারা আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করে। পরে আমরা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় কাজ করি। ২০১৬ সালে ১০৫জন কৃষক-কৃষাণী তামাক চাষে জড়িত ছিলেন। ২০২০ সালে হালদা নদীর পাড়ে তামাক চাষ করেন মাত্র ১জন তামাক চাষী। পল্লী কর্ম সহায়তা ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও আইডিএফ তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকায়নে গরু-ছাগল, গাছের চারা প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে তামাকচাষীরা মূলধারার কৃষি কাজে ফিরে এসেছেন। আমরা এখন নতুন করে গবেষণা চালাচ্ছি আগের তুলনায় বর্তমানে লাভবান হচ্ছে কিনা। তামাক চাষ থেকে ফিরে আসা কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ তামাক চাষ থেকে ফিরে আসা চাষীদের সরকারি প্রণোদণা দেওয়ার। যাতে তাদের তামাক চাষের পরিবর্তে অন্য কৃষি কাজে নিয়োজিত রাখা যায়। কৃষকদের দাবি সরকারি প্রণোদনা, কৃষি কাজে প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পাহাড়ে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। 

তিনি আরও বলেন, যে পরিবর্তন এসেছে সেটা রক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ রক্ষা করার স্বার্থে তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া উচিত। 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়