পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করেই রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম ছাড়ছে দূরপাল্লার বাস

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ২০:০৮, ৯ মে ২০২১
পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করেই রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম ছাড়ছে দূরপাল্লার বাস

ছবি : সিভয়েস।

ঈদের আগে ঘরমুখী মানুষের চাপকে পুঁজি করে সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই রাতের আঁধারে চলছে দূরপাল্লার বাস। প্রতিদিনই চট্টগ্রাম থেকে বাস ছেড়ে যাচ্ছে ঢাকা, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করেই প্রতিরাতে সব আসন পূর্ণ করে বাসগুলো চলাচল করছে— এমনটাই জানিয়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে দেশের যেকোন প্রান্তে যেতে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যাত্রীদের।

শনিবার (৮ মে) রাত ১০ টার পর নগরের এ কে খান মোড় ও গরীবুল্লাহ শাহ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কাউন্টার বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে আশপাশে ঘুরছেন টিকিট বিক্রেতারা। যাত্রী পেতে বাস সংশ্লিষ্টরাও নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। বাসের সামনে ‘অতি জরুরি বিদেশগামী বিমানযাত্রী’ ‘বিদেশগামী যাত্রী পরিবহন’ ‘পুলিশ’ ইত্যাদি স্টিকার লাগিয়ে দেদারসে করছে যাত্রী পরিবহন। 

এছাড়াও দেখা গেছে, নগরের এ কে খান মোড়ে রাস্তার বিভিন্ন পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে বাস। টিকিট কেটেই যাত্রী সরাসরি উঠে যাচ্ছেন বাসে। যারা গরীবুল্লাহ শাহ থেকে টিকিট কাটছেন, তাদেরকে মাইক্রোবাসে করে এ কে খান পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারের পাশাপাশি ট্রাক, পিকআপেও চট্টগ্রাম ছাড়ছে অসংখ্য মানুষ।

নগরের এ কে খান মোড়ে ‌‘ঢাকা-ঢাকা’ বলে যাত্রী ডাকছিলেন এক ব্যক্তি। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম জেনে আপনার কাজ কি! টিকিট লাগবে কিনা সেটা বলেন।’ কোন বাসের টিকিট বিক্রি করছেন জানতে চাইলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘শ্যামলী বাসের এসি-নন এসি দুটোরই টিকিটি আছে। ঢাকায় যেতে হলে নন এসি বাসে ৯শ’ টাকা ও এসি বাসে ১ হাজার ৫শ’ টাকা দিতে হবে।’ 

স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নন এসি বাসে ৪৮০ টাকা ও এসি বাসে ১ হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হয়। দ্বিগুণ ভাড়া কেন আদায় করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে গাড়ি চালানোর অনুমতি নিতে হয়। হাজারের নিচে টাকা না দিলে পুলিশ গাড়ি ছাড়তে দেয় না। ভাড়া বেশি না নিয়ে তো আর উপায় নাই।’

এসময় এ কে খানস্থ শ্যামলী কাউন্টারে বাইরে থেকে কাউন্টার বন্ধ রাখলেও ভেতরে যাত্রীদের উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। 

নগরের গরীবুল্লাহ শাহ এলাকায় সৌদিয়া কাউন্টারে ঢাকায় যাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে রানা নামের এক টিকিট বিক্রেতা বলেন, ‘বিজনেস ক্লাস ও ইকোনমি ক্লাস দুটো গাড়িতেই যাওয়া যাবে। একটি গাড়ি রাত সাড়ে ১১টায় আরেকটি ১২টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।’
 
নিষেধাজ্ঞার মধ্যে গাড়ি চালালে পুলিশ ধরবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মাঝে মাঝে চেক করে, মাঝে মাঝে করে না। আপনি যাবেন কিনা সেটা বলেন। আমাদের অনুমতি নেওয়া আছে।’

নগরের এ কে খান মোড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে চাকরি করি। ঢাকায় আমার মা খুব অসুস্থ। তার উপর সামনে ঈদ। তাই পরিবার নিয়ে একসাথে ঢাকায় যাবো।’

দূরপাল্লার বাস বন্ধ, টিকিট পেয়েছেন কিনা জনতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখি সবকিছু বন্ধ। কিছুক্ষণ পর দেখি এক লোক এসে কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলেন। ঢাকায় যাব বলার পর ৯শ’ টাকা চাইলো টিকিটের দাম। স্বাভাবিক সময়ে ৪৮০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। আমাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে তারা দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছেন।’
 
রাত ১২টায় এ কে খান মোড়ে এসে থামে আর এম ট্রাভেলসের একটি বাস। সারিবদ্ধভাবে বাস থেকে নামছেন যাত্রীরা। ওই বাসের যাত্রী এনাম হায়দারের সাথে কথা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকি। মা বাবার সাথে ঈদ করতে চট্টগ্রামে এসেছি। পথে দুইবার গাড়ি আটক করেছিল পুলিশ। দুবারই টাকা দিয়ে আবার গন্তব্যের দিকে ছুটেছেন চালক। বাড়তি ভাড়া দিলেও বাসটি তেমন আরামদায়ক ছিল না।’ 

যাত্রা পথে বিরতিতে বিভিন্ন হোটেলের সামনে দূরপাল্লার বাস ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাসভর্তি যাত্রী নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে বাসগুলো। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও উত্তরবঙ্গের দিকে ছুটছে দূরপাল্লার বাসগুলো।’

কুমিরা হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সিভয়েসকে বলেন, ‘রাতের আঁধারে কোনো বাস চললে বা যাত্রী পরিবহন করলে আমরা প্রত্যেকটা গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। সরকারি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত বিধিনিষেধ মেনে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

দেশে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যে গত ১৪ এপ্রিল এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন দেয় সরকার। এরপর এক সপ্তাহ করে ১৬ মে পর্যন্ত সেই বিধিনিষেধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে ২২ দিন পর মহানগর কিংবা জেলার ভেতর গণপরিবহন চালু হলেও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে সরকার। 

এদিকে শনিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি শাজাহান খান এমপি বলেছেন, ‘গাড়ি বন্ধ থাকলেও মানুষের যাতায়াত বন্ধ থাকে না। এটা বিশেষজ্ঞদের জানা নেই। পাঁচ দফা দাবি না মানলে ঈদের দিন সারাদেশে বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডে সকাল ১০টা থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে।’

তাই লোকাল গাড়ির মতোই দূরপাল্লার গাড়ির জন্য লকডাউন শিথিল করারও দাবি জানান এই শ্রমিক নেতা। যদিও একই সঙ্গে সরকারি নিদের্শনা অমান্য করে দূরপাল্লার যেসব গাড়ি ছাড়ছে, এর সঙ্গে মালিক সমিতির কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন সাবেক এই মন্ত্রী।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়