চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ার, তুমি কার?

শারমিন রিমা 

প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) প্রধান প্রকৌশলীর পদ নিয়ে নানা নাটক চলছে। গত নভেম্বরে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে সরিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অন্য একজনকে পদায়নের পর থেকে এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বদলি হওয়া প্রধান প্রকৌশলী একদিন হাসপাতালে থেকে মন্ত্রণালয়ের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছেন। অন্যদিকে নতুন পদায়ন হওয়া প্রধান প্রকৌশলী নবীউল ইসলামও হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন চসিকে তাঁর দায়িত্বভার বুঝে পেতে। এভাবে প্রায় ২০ দিন ধরে চলছে চেয়ার টানাটানি। শেষ পর্যন্ত রফিকুল নাকি নবীউল- কে বসবেন প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে! বিষয়টির কোনো সুরাহায় এগিয়ে আসছে না সিটি করপোরেশন কিংবা মন্ত্রণালয়। উল্টো মুখে কুলুপ এঁটেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

অথচ দুজনের হাতেই রয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তা বুঝতে পারছে না চসিক। সংস্থার আইন কর্মকর্তা তাকিয়ে আছেন মন্ত্রণালয়ের দিকে।

এদিকে নিয়মিত অফিস করছেন রফিকুল ইসলাম। আর চসিকের এ দরজা-ও দরজা ঘুরছেন পাবনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নবীউল ইসলাম।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২১ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে যোগদানপত্র জমা দিতে যান নতুন প্রধান প্রকৌশলী নবীউল ইসলাম। ওই সময় চসিক মেয়র তা গ্রহণ না করে যোগদানের বিষয়ে পরে জানানো  হবে বলে জানান। একদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর রফিকুল ২৩ নভেম্বর আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আসেন চসিকে। এরও আগে মন্ত্রণালয়ের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ৩ ডিসেম্বর আপিল করে ওই আদেশের বিরুদ্ধে 'স্টাট্যাস কো' আনেন নতুন প্রধান প্রকৌশলী নবীউল। গত ৬ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশের ওপর উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের ব্যাখ্যাসহ  'স্ট্যাটাস কো' আদেশ নিয়ে আসেন তিনি। পরবর্তীতে ৭ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় সেই স্থিতি অবস্থার চিঠি চসিকে পাঠালে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা ‘উপরের নিষেধাজ্ঞা’ রয়েছে বলে তা গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে একইদিন প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের আইনজীবীর পাঠানো এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সন্ধ্যা ৭টায় গ্রহণ করেন চসিকের সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মন্ত্রণালয়ের আদেশের উপর রিট করেছি। আদালত থেকে স্থগিতাদেশও পেয়েছি। তাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেই বহাল আছি। তাছাড়া মন্ত্রণালয় হাইকোর্টের আদেশের উপর ব্যবস্থা নিতে চিঠিও দিয়েছে। তিনি (নবীউল ইসলাম) অ্যাপিলেট ডিভিশনে আমার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছেন। আমার মামলা আর তার মামলা এক নয়। তার (নবীউল ইসলাম) এখানে আসার এতো আগ্রহ কেন?’

একই প্রসঙ্গে চসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন প্রধান প্রকৌশলী মো. নবীউল ইসলাম বলেন, ‘থার্ড পার্টি হিসেবে আমি আপিল করেছি। আমার যে ‘স্ট্যাটাস কো’ দেওয়া হয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের আদেশের ওপর। আদেশ অনুযায়ী ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি (রফিকুল ইসলাম) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নাই। কিন্তু উনার আইনজীবী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে এই বিষয়টা হাইড (গোপন) করে গেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে আমার অর্ডার হয়েছে। আমি জয়েন করেছি এখন কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করলে আমি কাজ শুরু করবো। যেহেতু রিসিভ করেনি তাই সেখানে কয়েকদিন গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি। এখন বাকিটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’

কী বলছে চসিক-মন্ত্রণালয়

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্রধান প্রকৌশলী পদে কে বসবেন- আদালতের নির্দেশনা কি বলছে এ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘দুজনই বলছেন দুজনই সঠিক। এখন বাকিটা বলতে পারছি না। প্রাথমিকভাবে কথা হয়েছে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নিবো। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেহেতু বদলির আদেশও মন্ত্রণালয় দিয়েছে আবার নতুন কর্মকর্তাকে পদায়নও মন্ত্রণালয় করেছে। তাই সিদ্ধান্তও মন্ত্রণালয়ের।’

তবে বৈধভাবে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী এখন কে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি সংস্থাটির আইন কর্মকর্তা।

এর আগে, রফিকুল ইসলামের আদালতের স্থগিতাদেশের চিঠিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২৬ নভেম্বর। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে ৪ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবা আইরিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চসিকের প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তাকে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে চসিকের প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বর্তমানে দেশের বাইরে ছুটিতে রয়েছেন। তাই এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানা যায়নি।

পরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহীর পদে থাকা চসিক সচিব খালেদ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। মন্তব্যের জন্য দেখিয়ে দেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর একান্ত সচিব আবুল হাশেমকে। তাকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তাই তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবা আইরিন (সিটি করপোরেশন ২ শাখা) বলেন, ‘আমার আসলে এসব বিষয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার নেই। আপনি আমার সিনিয়র যে স্যারেরা আছেন তাঁদেরকে ফোন দেন।’

কি আছে চসিকে!

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পদ টানাটানির ঘটনা নতুন নয়। এর আগে সংস্থার সচিব পদ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছিল একই ধরনের জটিলতা। আদালতে না গড়ালেও বর্তমান সচিব খালেদ মাহমুদের স্থলে বদলি হয়ে আসা সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের (গণপূর্ত) উপ-পরিচালক কাজী শহিদুল ইসলাম যোগ দিতে পারেননি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। ১২দিন ঘোরাঘুরির পর মন্ত্রণালয় থেকে তাকে ঠাঁই করে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম ওয়াসায়। এ ঘটনার তিন মাসের মাথায় এবার ঘটলো গুরুত্বপূর্ণ আরেক পদ নিয়ে। সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী পদে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবীউল ইসলামকে পদায়ন করা হলেও চেয়ার ছাড়তে রাজি নন বদলি হওয়া প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম। তাঁর দাবি, অবসরে যাওয়ার চার মাস আগে বদলির কোনো আইন নেই। সেই আইন আঁকড়ে তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে থাকতে চাইছেন।

এমন পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খলা বলে অভিহিত করছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, বদলির পরও পদ না ছাড়া, আদালত পর্যন্ত গিয়ে ঊর্ধ্বতনরা একটি বাজে উদাহারণ রেখে যাচ্ছেন। সিটি করপোরেশন মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যেকোনো সময় যে কাউকে বদলি করতে পারে। আমরা চাকরি করি, যখন যেখানে বদলি করে যেতে বাধ্য। সুবিধা-অসুবিধা থাকতেই পারে, সেটা নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা করে সমাধানে যাওয়া উচিত। আবার এসব ঘটনাকে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র বলেও মনে করছেন।

উচ্চ আদালতের আদেশকে গ্রাহ্য না করা যেনতেন বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, সরকার পক্ষের একজন অ্যাটর্নি জেনারেলের চিঠির কপি এখানে গ্রহণ করা হল না এটা যেনতেন বিষয় না। এভাবে চলতে থাকলে কাউকে বদলি করা যাবে না, সবাই আদালতে যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের বদলি করা হলেও তারা কেউই যেতে চান না। কর্তৃপক্ষও ছাড়তে চান না। তার কারণ কী? নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু বা স্বার্থ আছে? নইলে কর্মকর্তারা কেন এখানে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করবেন? আর এমন ঘটনা একের পর এক ঘটা মানে চসিকের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।’

বদলির পর হাসপাতালে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল, নবীউলের পদায়ন

গত ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে বরিশাল সিটি করপোশেনে বদলি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বদলির আদেশে তাকে ২২ নভেম্বরের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে বলা হয়। নতুবা ২৩ নভেম্বর থেকে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ হিসেবে গণ্য করা হবে জানানো হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মাহবুবা আইরিন স্বাক্ষরিত ওই আদেশে।

আরেকটি আদেশে ১৯ নভেম্বর পাবনার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নবীউল ইসলামকে পদায়ন করা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। তিনি ২১ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে যোগদানপত্র জমা দিতে যান। 

অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ছেড়ে বদলিকৃতস্থানে যোগদানের দুদিন আগে হঠাৎ বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। সে সময় গুঞ্জন উঠেছিল, বদলি ঠেকাতে’ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে (২৩ নভেম্বর) আদালত থেকে  স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন রফিকুল। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১০ দিনের ছুটির জন্য আবেদন করেন তিনি। যদিও চসিক সেই ছুটি মঞ্জুর করেছে কিনা তা জানা যায়নি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়