‘রাজাকাররা বুড়ো হয়ে গেছে, স্বপ্ন পূরণ হবে না’
মেজর জিয়ার কারণে মাহফুজের জীবনরক্ষা!
মিনহাজ মুহী, সিভয়েস২৪

ডা. মাহফুজুর রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। পেশায় চিকিৎসক। ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র-ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম’ এর চেয়ারম্যান। ৫৪তম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সিভয়েস২৪.কম তাঁর একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এ সময় ডা. মাহফুজ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, স্মৃতিচারণ, অপারেশন, জনগণের দেশপ্রেম, আক্ষেপ, ইতিহাস বিকৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী নামে ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ একটি গেরিলাযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল। ডা. মাহফুজ বিএলএফ’র একজন কমান্ডার ছিলেন। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ১ নম্বর সেক্টরের অনেক কিছুর নাম ছিলো চট্টগ্রাম ঘিরে। বিএলএফ গ্রুপ গঠন করে দেশে পাঠানোর আগে তাদের নামকরণ হয় এখানকার নদী কর্ণফুলীর নামে। যেমন; কেসি-১, কেসি-২ ও কেসি-৩। কেসি মানে 'কর্ণফুলী কনটিনজেন্ট'। ডা. মাহফুজুর রহমান কেসি-৩-এর কমান্ডার ছিলেন। তিনি বিস্ফোরক বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে প্রায় সব বিস্ফোরণ অপারেশন ডা. মাহফুজুর রহমানের গ্রুপই পরিচালনা করে।
জিয়াউর রহমান না চিনলে মারা যেতেন গণপিটুনিতে
মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধের সময় একদিন আমি বিপদে পড়েছিলাম। তখন আমাদের কমান্ডার ছিলেন ১ নম্বর সেক্টরের মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি গ্রুপ করে হরিণা ক্যাম্প থেকে আমাদের পাঁচজনকে চট্টগ্রাম শহরে পাঠিয়ে দিলেন। শহরে তখন যুদ্ধ চলছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়। সীতাকুণ্ডের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী। মিরসরাইয়ের দিকে মুক্তিবাহিনী।’
এমন পরিস্থিতিতে ক্রসফায়ারে পরার আশঙ্কায় মাহফুজুর রহমানরা কিছুপথ এসে আবার ফিরে যাচ্ছিলেন ক্যাম্পে। একপর্যায়ে সেখানে স্থানীয় জনগণ তাকে ঘেরাও করে ফেলে। জনতা মনে করেছিল, তিনি রাজাকার, হানাদারদের সহযোগী।
মাহফুজ বলেন, ‘তাদের বুঝিয়ে বললাম, চলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে উপরে, সেখানে যায়। ওনারা যদি আমাদের রাজাকার বলেন, তাহলে আমাকে মেরে ফেলবেন আপনারা। পরে ক্যাম্পের কাছাকাছি যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি দূর থেকে জিয়াউর রহমান চিৎকার দিয়ে ওঠলেন। বললেন, মাহফুজ তুমি এখানে কেন? তোমার তো শহরে থাকার কথা। এ সময় ক্ষুব্ধ জনগণ বুঝতে পারলো আমি মুক্তিযোদ্ধা। ওরা চলে গেল। আমি গণধোলাই থেকে বেঁচে গেলাম। ওই দিন জিয়া যদি আমাকে চিনতে না পারতেন মহাবিপদ ঘটে যেত।’
‘ঘটনাটি এখনো আমাকে ভীষণ ভাবায়। মহাব্যস্ত এক সেনা অফিসার, যোদ্ধা, কমান্ডার কী করে শত সহযোগীর নাম মনে রাখেন! ওই দিন যদি আমার নাম ওনার মনে না থাকত, তাহলে নিশ্চিত আমি মারা যেতাম। পরিচিতজনদের নাম মনে রাখার মহাজাদু ছিল জিয়াউর রহমানের। তার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর।’ —যোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজ।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ যেভাবে...
১৯৬২ সাল। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনবিরোধী আন্দোলন চলছিল। তখন মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুলে পড়ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার চট্টগ্রামের মন্ত্রী এম এ মান্নানসহ কয়েকজন তাকে বললেন, ‘‘দেখো মাহফুজ তোমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ আইয়ুব খান একটা কমিশন গঠন করছে, বড় লোকের ছেলেরা ছাড়া কেউ লেখাপড়া করতে পারবে না। আইয়ুব খান বাংলা বর্ণমালাকে পরিবর্তন করে দিবে, আরবি-উর্দু মিলে একটা নতুন বর্ণমালা সৃষ্টি করা হবে। তোমাদের এমন শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে এবং আইয়ুব খানের পতন ঘটাতে হবে।’
মাহফুজ বলেন, ‘তাদের কথা শুনে বুঝলাম, খুব শিগগিরই আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এরপরে তো আর কোনো কথা নেই। তখন আমরা আন্দোলনে নামলাম।’
‘এরপর ১৯৬৪ সালের আন্দোলন। তখন আমি চট্টগ্রাম কলেজে। সেই সময় ছাত্রলীগ করতাম। ছাত্রলীগের এস এম ইউসুফ ছিলেন অন্যতম নেতা। তিনি আমাদের বললেন, আন্দোলন তো অনেক করলা এগুলো দিয়ে হবে না; বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করা হলো। সেই দাবিগুলো কোনোভাবেই পাকিস্তান মানবে না। কারণ, ৬ দফা মেনে নেওয়া মানেই পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে।’—যোগ করেন মাহফুজ।
মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, ‘১৯৬৭ সালে একদিন চট্টগ্রামের অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ও ঢাকার কাজী আরিফ আহমেদ আমাদের বাসায় এলেন। তারা বললেন, মাহফুজ তোমরা ৬ দফা নিয়ে আন্দোলন করছো। কিন্তু পাকিস্তান তো এই ৬ দফা মানবে না কখনো। এবং কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দিবে না। তাই তোমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন করতে হবে।’
‘‘তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটার নেতা কে? তারা বললেন, সিরাজুল আলম খান প্রধান নেতা। আমি আছি আর আওয়ামী লীগের রাজ্জাক। আমরা এ তিনজন। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম আর কেউ নেই? তখন তিনি বললেন, ‘সবার উপরে বঙ্গবন্ধু।’ কারণ, তখন আমরা বঙ্গবন্ধুভক্ত। এরপর ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমরা চট্টগ্রামে স্লোগান দিতে থাকি— ‘তুমি কে আমি কে; বাঙালি, বাঙালি’, ‘আমার তোমার ঠিকানা; পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি। এরপর ১৯৬৮ সালে একটা নতুন স্লোগান যুক্ত হলো— ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সর্বদলীয় গণঅভ্যুত্থান। তখন আমরা ‘জয় বাংলা’ ও ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এসব স্লোগান দিতাম।’’
তিনি বলছিলেন, ‘‘এভাবেই চলতে চলতে এলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। পুরো চট্টগ্রাম শহর বক্তব্য দিয়ে চষে বেড়িয়েছি। তখন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা এভাবে বক্তব্য দিতে পারতেন না। কিছু বললেই গ্রেপ্তার হয়ে যেতেন। ওইসময় আস্তে আস্তে চট্টগ্রামের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে ওঠছিল।’
১৯৭১ সালে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ওই সময়ে ডা. মাহফুজ ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ৫ম বর্ষের ছাত্র। মেডিকেল কলেজে একটা ট্রেনিং সেন্টার হলো তার নেতৃত্বে। আরেকটা আমবাগান, অন্যটি আগ্রাবাদ জাদুঘর মাঠে।
‘মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমরা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি। ৩ মার্চ পাহাড়তলীতে দাঙ্গা হলো। পরে মেডিকেল কলেজে এসে দেখলাম প্রায় শ খানেক লাশ এলো। এভাবেই মার্চ গেল অসহযোগ আন্দোলনে। মজার বিষয় হলো, যেই স্লোগানগুলো আমরা ৬৭ সাল থেকে দিয়েছিলাম সেই স্লোগানগুলো ১ মার্চ থেকে বাংলার জনগণ দেওয়া শুরু করলো।’ —যোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ।
যুদ্ধের প্রস্তুতি—
যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘১৬ মার্চ আমরা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ গিয়ে আন্দরকিল্লা এলাকার একটি বন্দুকের দোকান লুট করি। সেখানে ছিলাম আমি, আবদুল্লাহ আল হারুন, ফাহিম উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন। লুট করা বন্দুকগুলো আমরা বিভিন্ন জায়গায় রাখি। ২৬ মার্চ এসব বন্দুক নিয়ে আমরা একটা বিল্ডিংয়ে আক্রমণ করি। ২৭ মার্চ সকাল বেলা বোয়ালখালীর এম এ মান্নান এলেন মেডিকেল কলেজে। তিনি বললেন, তার সঙ্গে বেতারে যেতে। যাওয়ার পথে আমাদের সঙ্গে সেই বন্দুকগুলো ছিল। বেতারে আবদুল্লাহ আল হারুন ভাই কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন খুব উত্তেজিত সুরে। পরে তিনি এসে বললেন, আর্মির কোন জিয়া জিজ্ঞেস করতেছে আমরা এখানে কি করি। ছাত্রদের এখানে কাজ কি! তখন তো উনাকে চিনতাম না। পরে সেখান থেকে আমরা চলে আসি।’
বেতারের কথা তুলে ধরে মাহফুজ বলেন, ‘২৬ মার্চ দুপুরে প্রথম অধিবেশন হলো এম এ হান্নানের, দ্বিতীয় অধিবেশন সন্ধ্যায় আবুল কাশেম সন্দ্বীপের, তৃতীয় অধিবেশন রাতে রঙ্গলাল দেব চৌধুরীর। এরপর ৪র্থ অধিবেশন অর্থাৎ পরেরদিন ২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন শুরু করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতারা। আর ৫ম অধিবেশন অর্থাৎ ওই দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে দেন স্বাধীনতার ঘোষণা। পরে আওয়ামী লীগের নেতারা উনাকে বুঝিয়ে বললে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষেই (on behalf of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman) ঘোষণাটি দেন।’
তাঁর মতে, জিয়ার ঘোষণাটা জনগণকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। কারণ, একজন সেনা মেজর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আছেন —এটা অনেক বড় বিষয় ছিল ওই সময়।
এরপর সেখান থেকে চুয়েটে চলে গেলেন মাহফুজ। পরে চুয়েট থেকে পটিয়া। সেখান থেকে ফেরার সময় শুনলেন তাঁর আব্বা-আম্মা ভাই-বোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে চলে গেছেন। পরে তিনি পাহাড়তলী সরাইপাড়া গিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে চলে গেলেন বাড়বকুণ্ড পাহাড় হয়ে ফটিকছড়ি, রামগড়। রামগড়ে ছিলেন সাত-আট দিন। এরপর চলে গেলেন সাব্রুম। সেখান থেকে হরিণা, হরিণা থেকে বাঘাপাড়ায় একটি ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে সাতদিনের ট্রেনিং নেন মাহফুজ।
‘দেশে ফিরে আমরা প্রতিনিয়ত একটা দুটা করে অপারেশনে যেতাম। এভাবেই চলছিল ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৩ ডিসেম্বর সকালে শুনলাম চিরুনি অভিযান চলবে। তখন আমরা আগ্রাবাদের একটা ড্রেনে পানিতে শরীর ডুবিয়ে লুকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি বিমান উড়ছে। খবর নিয়ে জানলাম, সেটা ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ। মনে আনন্দ জাগলো। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। তবে চট্টগ্রাম পুরোপুরি স্বাধীন হয় একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর’—যোগ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের টুকরো স্মৃতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে ডা. মাহফুজ বলেন, ‘ফয়’স লেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা যৌথ অপারেশন ছিল। প্রায় ৭০-৮০ জনের একটি ট্রেনিং অপারেশন। আমরা ৮-১০ জন একসাথে যাচ্ছিলাম সেখানে। ফজরের আজানের সময় পাঞ্জাবি লেনের মুসল্লিরা ডাকাত ভেবে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধা) ঘিরে ফেলে। একজন আমাকে চিনতে পেরেছেন। তখন তিনি বললেন, মাহফুজ তুমি এখানে...আচ্ছা বুঝতে পারছি। আর কিছু বলতে হবে না। পরে মুসল্লিরা আমাদের সেইফ জোনে পার করে দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিভাবে ছিল! ঘটনাটাই আমার জন্য বড় উদাহরণ। যা এখনো মনে দাগ কাটে।’
মুক্তিযুদ্ধ যে ন্যায়ের পক্ষে ছিল সেটা তখনকার একটি ছোট ছেলেও বুঝতে পেরেছিল— এমনটা জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘মোগলটুলি গরিবুল্লাহ শাহর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানে রাতে খাবার সেরেছি। বাড়ি থেকে ১০ হাত দূরে একটু দোতলা বিল্ডিং ছিল। ওখানে আমরা ৪/৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। পাশে একটা বিল ছিল। যাতে হানাদার বাহিনী এলে বিলে ঝাঁপ দেওয়া যায়।’
সকালবেলা মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, গরিবউল্লাহর ভাইয়ের হাত ভাঙা, মায়ের কবর...। সবার চেহারা বিধ্বস্ত; এমনকি তার ছোট ছেলেটার চেহারাও করুণ। জিজ্ঞেস করলে প্রতিউত্তরে তারা বললেন— ‘রাতে ওরা (হানাদার বাহিনী) এসেছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা বলেননি এতো নির্যাতনের পরও!’
‘এই যে ছোট ছেলেটা জানতো আমরা কোথায় আছি। কিন্তু নির্যাতনের পরও মুখ খোলেনি। ছোট ছেলেটাও বুঝেছে ন্যায়-অন্যায়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ কখনো আমাদের বিরোধিতা করেননি। জনগণের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। এমন আরও অনেক স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। আমৃত্যু ভুলবো না। জনগণ সহযোগিতা করেছিল বলেই আমরা গেরিলাযুদ্ধ করতে পেরেছি।’ —বলেন ডা. মাহফুজ।’
বিজয়ের ৫৪ বছরে এসেও নানা আক্ষেপ…
মহান বিজয়ের ৫৪ বছরে এসেও আক্ষেপ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এ গেরিলাযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা; এসব লক্ষ্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে ৭২ এর সংবিধানের লক্ষ্য ছিল— সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন হবে, একমুখী-গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হবে, দেশের সকল নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা বাসস্থান, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। তবে বিজয়ের ৫৪ বছরে এসে একটি লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। সংবিধানের মূলনীতিগুলোর একটাও বাস্তবায়ন হয়নি। এসব ভেবে আক্ষেপ কাজ করছে।’
জাসদ নেতা ডা. মাহফুজ আরো বলেন, ‘এগুলোর লক্ষ্য নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। ৫৪ বছরে যদি একটি লক্ষ্যও বাস্তবায়িত না হয়; তাহলে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধা) আক্ষেপ তো থাকবেই। তবে জানি না কেন হয়নি!’
ডিসেম্বরে এবার সব কিছু কেমন যেন!
বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন এ গেরিলাযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘গত তিন মাস (৫ আগস্টের পর) আমি কোনো শাসন দেখি না। শুধু দেখি জনগণের দেশপ্রেম। এ তিন মাস যদি অন্য কোনো দেশে চলতো, লুটপাটের শেষ থাকতো না। কিন্তু দেশে কোনো লুটপাট হয়নি। জনগণ এখনো চলাফেরা করতে পারছে। বাকিটা যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তাদের সামনের কার্যক্রমে বুঝা যাবে। তবে বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক।’
গেল কয়েক বছরের বিজয়ের মাস আর এবারের ডিসেম্বরের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ছে ডা. মাহফুজুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘এবার সব কিছু কেমন যেন! উৎসাহ-উদ্দীপনার বড্ড অভাব।’
আমাদের স্বাধীনতা মানেই একাত্তর, দ্বিতীয় স্বাধীনতা হয় না
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ বলেন, ‘কোনো দেশ তো দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয় না! দেশ একবারই স্বাধীন হয়। ওরা এটা আবেগ থেকে বলছে আর কি! দীর্ঘদিনের স্বৈরাশাসন হটাতে পেরেছে; এটা তাদের (ছাত্র-জনতা) কাছে স্বাধীন মনে হয়েছে। এ প্রজন্ম তো শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো সরকার দেখেনি। যাদের বয়স এখন ২৩-২৫; তারা শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য সরকারকে রিয়ালাইজ করতে পারেনি। তাই তারা শেখ হাসিনার পতনের পর এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে। এরপরও তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বললেও কি আর ‘না করা যাবে! বলুক...! তবে আমাদের স্বাধীনতা বলতে মহান একাত্তরই।’
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্র-ট্রাস্টের কার্যক্রম প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার (ভিডিও) নেওয়া হচ্ছে। সেগুলো আমাদের ওয়েবসাইটে দিচ্ছি। এটাই আপাত কার্যক্রম।’
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভাজন জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়
মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেকে বিরোধিতা করেছেন। তবে বিজয়ের ৫৪ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের বিভাজন জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মন্তব্য করেছেন গেরিলাযোদ্ধা মাহফুজ। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৪ বছর। এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের বিভাজনটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আর রাজাকার যারা ছিল তারা তো বয়স্ক হয়ে গেছে। তবে আবার রাজাকারও আসতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে পারে। বাংলাদেশকে অস্বীকার করা হতে পারে— এটা বিচিত্র কিছু নয়।’
‘যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের আবারও আনাগোনা’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তারা তো সবাই বুড়ো হয়ে গেছে। তাদের আনাগোনা বাড়িয়ে লাভ কি! তারা তো এখন বাংলাদেশকে আর পাকিস্তান বানাতে পারবে না। তবে এ রকম আনাগোনা কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে করে তাহলে বলবো— এ বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো সম্ভব না। এমন অবাস্তব চিন্তা করে লাভ নেই। কারণ জনগণ এখনো মুক্তিযোদ্ধাকে মনে রাখছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো সম্মান করে।’
তালিকাভুক্ত হতে আবেদনে মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষর করা অসম্মানজনক
‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে ফরমে স্বাক্ষর করা অসম্মানজনক’ উল্লেখ করে মাহফুজ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হয়। তবে স্বাধীনতার পর থেকে এ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। আমাদের শাসন কাঠামোটা এ রকম! মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হলে একটা অসম্মানজনক ফরমে স্বাক্ষর করতে হয়। ১০ লাখ টাকা ঘুষ না দিলে কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়, অথচ বেইজ্জতের কোনো শেষ নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা ইউএনওকে স্যার না ডাকলে তারা রাগ করেন। ডিসিকে স্যার ডাকতে হয়; এসব কিসের সম্মান মুক্তিযোদ্ধাদের!’
ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না
ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধা গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একদল বলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক; আরেকজন বলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না। জিয়ার অবদান; জিয়ার জায়গায়; বঙ্গবন্ধুর (শেখ মুজিবুর রহমান) অবদান; বঙ্গবন্ধুর স্থানে থাকবে। মাওলানা ভাসানির ইতিহাস বিস্মৃত করা হয়েছে; ভাসানি অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। তাজউদ্দিন আহমেদ; যিনি না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। তাঁকেও (তাজউদ্দিন আহমেদ) ইতিহাসের পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এগুলো ইতিহাসে যথাসময়ে স্থান করে নেবে। এসব নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাবি না; এগুলো ইতিহাস হিসেবে ওঠে আসবেই একদিন।’
সিভয়েস২৪/