ভাংতির অজুহাতে অনিয়মই যখন ‘নিয়ম’! 

মিনহাজ মুহী

প্রকাশিত: ২০:০৯, ১১ আগস্ট ২০২২
ভাংতির অজুহাতে অনিয়মই যখন ‘নিয়ম’! 

জ্বালানি তেলের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে আবারও ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আর এতে আগের ভাড়ার চেয়ে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। তবে নতুন এ বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ভাংতি টাকা না থাকার ‘অজুহাত’। যা ধীরে ধীরে ‘নিয়মে’ পরিণত হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যাত্রীরা।

কর্ণফুলী থেকে বাসে করে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বহদ্দারহাটে নামেন নাইমুল হোসেন। বর্ধিত ভাড়া ১৩ টাকা। তবে ১৫ টাকা দিতেই ভাংতি নেই বলে জানান হেলপার। দাবি করেও লাভ হয়নি। ততক্ষণে সেখান থেকে চলে যায় বাসটি।

শুধু নাইমুলের নয়; কর্ণফুলী থেকে লালদিঘীর বর্ধিত ভাড়া ২৩ টাকা। এই ভাড়া দেয়া নিয়েও তৈরি হয় বাকবিতণ্ডা। ভাড়া দেওয়ার জন্য ২৫ টাকা দেওয়া হলে বাকি ২টাকা ফেরত দেয়নি বাস হেলপার। এতেই যাত্রী এবং হেলপারের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। উল্টো এ বাড়তি টাকা আদায় করে ভাংতি না থাকার অজুহাতকেই টানছেন হেলপাররা।

অন্যান্য রুটের বাসগুলোতেও একই চিত্র দেখা যায়। বর্ধিত ভাড়ার পাশাপাশি ভাংতি না থাকার অজুহাতে বাড়তি ২ টাকা দেওয়া-নেওয়ায় কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ফলে এটা ‘নিয়মে’ পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসান কুতুব।

তিনি বলেন, ‘একদিকে নতুন ভাড়ার কারণে বাড়তি খরচ বেড়েছে। আবার গাড়িতে উঠে বর্ধিত ভাড়া দেওয়ার পরও ভাংতি নেই বলে বাড়তি টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তো এ অজুহাত ‘নিয়মে’ই পরিণত হবে। এগুলোর জন্য উচিত নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা। শুধু গাড়িতে নয়; কোনো দিক দিয়েই শান্তি নেই। সবকিছুর দাম বাড়তি। দিনশেষে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, খরচ বাড়ছে। কিন্তু মানুষের আয়ের উৎস বাড়ছে না, অফিসের বেতন বাড়ছে না।’

যে কারণে যাত্রীদের ক্ষোভ—

নতুন ভাড়া পুননির্ধারণের ৫ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও যাত্রী ও পরিবহন হেলপারদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। ভাংতির অজুহাতে যাত্রীদের কাছ থেকে ২ থেকে ৩ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। একদিকে বাড়তি ভাড়া অন্যদিকে ভাংতির অজুহাত— যা যাত্রী ও হেলপারদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণ। 

যাত্রীদের দাবি— যেসব জায়গায় খুচরা ভাড়া রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিআরটিএ’র বিবেচনা করার দরকার ছিল। খুচরা ভাড়ার জন্য হেলপার-যাত্রীদের মধ্যে অনেক সময় উচ্চস্বরে কথাবার্তা চিৎকার-চেঁচামেচির মতো ঘটনা ঘটছে। এসবের কারণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা।

কলেজ শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফরহাদ মুরাদপুর থেকে কালুরঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন। মুরাদপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তালিকায় যে ভাড়া আছে তার চেয়ে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। আবার তালিকাও দেখাতে পারে না অনেক গাড়ি। আবার অনেক বাসের হেলপার মুরাদপুর থেকে কালুরঘাটের ভাড়া ২০ টাকা দাবি করে। আবার তালিকায় ১৮ টাকা থাকার কথা বললে তখন ভাংতির দোহাই দিয়ে ২০ টাকা নিয়ে ফেলে। এভাবেই বাসের হেলপাররা বিভিন্ন কৌশলে যাত্রীদের পকেট কাটছে।’

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাড়তি কোনো টাকা আদায় করা হচ্ছে না বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। আবার অনেকে ভাংতি টাকার সংকট থাকার কথা স্বীকার করেন। তারা বলেন, ‘ভাংতি টাকা না থাকার কারণে আমরা যাত্রীদেরকে ২-১ টাকা ফেরত দিতে পারি না। কিন্তু আমরাও তো অনেক সময় যাত্রীরা ভাংতি নেই বললে তাদের কাছ থেকে ২-১ টাকা কম নিচ্ছি।’

কোন গন্তব্যে কত ভাড়া, ভাংতির অজুহাতে নিচ্ছে বাড়তি টাকা—

নগরের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলে বাস ভাড়ার চার্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে বহদ্দারহাট আসতে একজন যাত্রীকে দিতে হবে ১৩ টাকা; আগে ছিল ১১ টাকা। তবে নতুন করে ২ টাকা বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে ভাংতির অজুহাতে আরও ২ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে কর্ণফুলী থেকে লালদিঘীর ভাড়া এখন ২৩ টাকা; আগে ছিল ১৯ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে ওয়ারলেস কলোনি ১৩ টাকা; আগে ছিল ১১ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে বানুর বাজার ৩৩ টাকা; আগে ছিল ২৮ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে ভাটিয়ারি ৩৮ টাকা; আগে ছিল ৩২ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে বারিক বিল্ডিং ১২ টাকা; যা আগে ছিল ১০ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে নিমতলা ব্রিজ ১৭ টাকা; যা আগে ছিল ১৫ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে সিমেন্ট ক্রসিং ২৭ টাকা; আগে যা ছিল ২৩ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে এয়ারপোর্ট ৪৭ টাকা; আগে যা ছিল ৪০ টাকা। লালদিঘী থেকে বাদামতলী ১২ টাকা; আগে যা ছিল ১০ টাকা। লালদিঘীর থেকে স্লট গোলা ২২ টাকা; আগে ছিল ১৮ টাকা। লালদিঘী থেকে সী-বিচ ৪২ টাকা; আগে ছিল ৩৬ টাকা। কোতোয়ালী মোড় থেকে জেলা পুলিশ লাইন ১৩ টাকা; আগে ছিল ১১ টাকা। কোতোয়ালী মোড় থেকে অলংকার ২৩ টাকা; আগে ছিল ২০ টাকা। নিউ মার্কেট থেকে রুবি গেট ১৩ টাকা; আগে ছিল ১১ টাকা। কালুরঘাট থেকে বাস টার্মিনাল ১৩ টাকা; আগে ছিল ১১ টাকা। কালুরঘাট থেকে বন্দর টিলা ৪৮ টাকা; আগে ছিল ৪১ টাকা। এভাবেই নগরের বিভিন্ন পথে যেমন ভাড়া বেড়েছে তেমনি ভাংতির অজুহাত দেখিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে আরও অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে বাস হেলপাররা।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘সময় স্বল্পতার কারণে একসঙ্গে সব গাড়িতে ভাড়ার তালিকা টাঙানো সম্ভব হয়নি। সব গাড়িতে যখন ভাড়ার তালিকা থাকবে তখন আর যাত্রী-হেলপারদের মধ্যে সমস্যা হবে না। অনেকে নতুন ভাড়ার তালিকাটা জানে না। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

তবে চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার বলেন, ‘বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। যারা নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। এ অভিযান চলমান থাকবে।’

এর আগে, গত ৫ আগস্ট রাত ১০টার দিকে অকটেন, ডিজেল, পেট্রোল ও কেরোসিনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে নতুন দর অনুযায়ী ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা, লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া অকটেনের দাম বেড়েছে ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা। প্রজ্ঞাপনে রাত ১২টার পর থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। আর এতেই পুরনো দামে জ্বালানি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল গাড়ি চালকরা।

এসময় রাতে পেট্রোল পাম্প থেকে ‘তেল না পাওয়ায়’ শনিবার (৬ আগস্ট) সকাল থেকে চট্টগ্রামে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপ। 

একইদিন দুপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে বৈঠকের পর চট্টগ্রামে গণপরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক সমিতি। পরে ডিজেল চালিত সব গণপরিবহনের বর্ধিত ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করে দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম নগরের বাসে ১৬.২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পরে রোববার নতুন ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সিভয়েস/এএ
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়