ক্যামিকেল গলিয়ে বিশ্বাস অর্জন, তারপর অলৌকিক কয়েন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ক্যামিকেল গলিয়ে বিশ্বাস অর্জন, তারপর অলৌকিক কয়েন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ

রফিকুল ইসলাম ওরফে তাঁরা মিয়া (৫৫) পড়েছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু এইচএসসির ক্যামেস্ট্রির (রসায়ন) বই পড়ে রপ্ত করেছেন কোন রাসায়নিকের সঙ্গে কোন রাসায়নিক মিশ্রণ করলে কি হবে! আর সেই রপ্ত করা জ্ঞান থেকে বানিয়েছেন ‘অলৌকিক কয়েন’। যার মধ্যে চিনি রাখলে তা গলে যায়। আর সাধারণ মানুষকে সেই ‘অলৌকিক কয়েন’ গলিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে প্রথমে বোকা বানায় তারপর বাড়তি দামে বিক্রি করার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় লাখ টাকা। এমন চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

বৃহস্পতিবার  (২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে নগরের পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার তিনজন হলেন— দলনেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে তাঁরা মিয়া (৫৫) ও তার দুই সহযোগী শাহেদ আহম্মদ খান (৪৪) এবং মোহাম্মদ আলমগীর (৩৭)।

বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান। 

তিনি বলেন, ‘তারা একটা প্রতারকচক্র এবং অজ্ঞান পার্টিরও সদস্য। তারা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। তারা ১৮৩৯ সালের ব্রিটিশ আমলের তামা ও সিরামিকের ভুয়া কয়েন দেখিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে। সিলেট এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার মানুষের সঙ্গে তারা ‘গেম খেলা’ বলে; যেটাতে নাকি চিনি দিলে চিনি গলে যায়। তারা প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল ব্যবহার করে মানুষকে দেখায় যে ১৮৩৯ সালের ব্রিটিশ আমলে মুদ্রা। এটার উপর চিনি দিলে চিনিও গেলে যায় এবং এটার একটা অলৌকিক শক্তি রয়েছে। এসব বলে মানুষকে বিশ্বাস করায়। এই কয়েন তারা নিজেরাই তৈরি করে এবং তা বানাতে তাদের কয়েন প্রতি খরচ হয় মাত্র ১শ-২শ’ টাকা। কিন্তু মানুষকে কয়েনের অলৌকিক শক্তির কথা শুনিয়ে হাতিয়ে নেয় ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত।

উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘শুধু এটাই নয়; গ্রেপ্তার তিনজন বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার কাজের সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল তৈরি করে অনেক সময় গরু চুরি, অটোরিকশা চালককে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন গরু চুরি করার জন্য গরুর মালিককে অজ্ঞান করতে চেতনানাশক ওষুধ খুঁজছিল। পরে সে জানতে পারে গ্রেপ্তার তিনজনের দলনেতার বাসায় ভালোমানের চেতনানাশক ওষুধ আছে। এবং সে নাকি সারাদেশেই বিভিন্ন মানুষের কাছে এসব ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। পরে সেই থেকে এ চক্রের সঙ্গে একে অপরের পরিচয় হয়। এরপর থেকে কয়েন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তারা।’

গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দলনেতা অষ্টম শ্রেণি পাস হলেও তার বাসা থেকে এইচএসসির ক্যামেস্ট্রির (রসায়ন) বই পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের দলনেতা তাঁরা মিয়া অষ্টম শ্রেণি পাস। তবে তার বাসা থেকে এইচএসসির ক্যামেস্ট্রির (রসায়ন) বই পাওয়া গেছে। সেই বইয়ের ভেতরে বিভিন্ন এসিডের নাম লেখা আছে। কোন রাসায়নিকের সঙ্গে কোন রাসায়নিক মিশ্রণ করলে কি হবে! এগুলো সবই তার মুখস্থ। পাশাপাশি সে রংয়ের ব্যবসাও করে। তার ক্যামিকেলের সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা আছে। তাই তার কাছে কয়েনগুলো করা থাকে। তার কাছে একটা মেশিন আছে; সেটার ভেতরে বসিয়ে শুধু চাপ দিলেই কয়েন তৈরি হয়ে যায়। বাসায় সব ধরনের উপাদান থাকায় আধঘন্টার মধ্যে এ ‘অলৌকিক কয়েন’ তৈরি করে ফেলতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের সারাদেশের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। তার কাজই হলো কিভাবে মানুষজনকে প্রতারণার শিকারে ফেলা যায়। তাদের চক্রের গ্রেপ্তার হওয়া শাহেদ আহম্মদ খান সিলেট থেকে এসেছেন। তার কাজ ছিল সিলেটের মানুষের কাছে এসব কয়েন বিক্রি করা। এ বিক্রির প্রেক্ষাপটে তিনি চট্টগ্রামে এসে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন এবং ওনার কাছ থেকে এসব কয়েন নিয়ে মানুষ বিশ্বাসও করে। মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য তাদের কৌশল হলো— মুদ্রার ভিতরে কিছু খালি জায়গা থেকে। যখন সাধারণ মানুষকে দেখায় তখন ওই কয়েনের মধ্যে কিছু ক্যামিকেল দিয়ে দেয়। ওইটার উপর যখন চিনি দেয় তখন চিনিগুলো অটোমেটিক গলে যায়। তাই সাধারণ মানুষ চিনি গলে যাওয়া দেখে সহজে বিশ্বাস করে ফেলে। আর তারা সাধারণ মানুষকে জানায় বিশ্বে এটার অনেক ডিমান্ড আছে; এটা তোমরা লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারো। এ বিশ্বাসে মানুষও তাদের কাছ থেকে অনেক দাম দিয়ে এসব কয়েন কিনে নেয়।’

প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা গেলেও কয়েন প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন কোনো ভিকটিম পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ভিকটিম পাওয়া যায়নি। তবে তারা পাঁচ বছর ধরে এসব প্রতারণার কাজের সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজনের মুরগির খামার ছিল; সেটি ব্যবসাগত কারণে চলে যাওয়ায় সে এই প্রতারণাচক্রের সঙ্গে জড়িত হয়। আর তাদের দলনেতা (তাঁরা মিয়া) দীর্ঘদিন ধরেই এসব কাজ করে আসছে। তারা সহজ-সরল মানুষকে টার্গেট করে একটা কয়েন ৫-২০ হাজার; আবার ৫০ হাজার টাকাতেও বিক্রি করে। আর সাধারণ মানুষকে জানায় এসব কয়েন তারা লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি করতে পারবে।’

উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশের বিবিরহাট কাঁচা বাজার এলাকা থেকে প্রতারক চক্র এবং অজ্ঞান পার্টির মূল হোতাসহ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৮৩৯ সালের ব্রিটিশ আমলের তামা ও সিরামিকের ভুয়া কয়েন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কথিত পুরাতন পয়সা তৈরির ডাইস, কথিত ব্রিটিশ পয়সা, তামা, পুরা মাটিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং চেতনানাশক দ্রব্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত ক্লোরফর্ম, পটাশিয়াম ক্লোরেড, হাইড্রোজেন সালফার এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফাইড্রিক এসিড, ইথিনিল, সালফার মনোক্লোরাইড, কস্টিক সোডা এবং কপার সারফাইড উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, দীর্ঘদিন যাবৎ পরস্পর যোগসাজশে সাধারণ লোকজনদের প্রাচীন মুদ্রার কয়েনে নির্দিষ্ট সময় চিনি রেখে তা গলিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে এবং বোকা বানিয়ে প্রতিটি কয়েন ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে বিক্রি করে। আর এ প্রতারণার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হয় তারা। প্রতারনার পাশাপাশি বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টিকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রনের মাধ্যমে চেতনানাশক রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করে সরবরাহ এবং বিক্রয় করে। অতঃপর ওই চেতনানাশক রাসায়নিক মিশ্রণ রুমাল, তোয়ালের সঙ্গে মিশ্রিত করে বাস, ট্রেন, সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহনে থাকা যাত্রীদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়। আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান।

-সিভয়েস/এমএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়