৫৮ বছরেও নিশ্চিত হয়নি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:০০, ১৮ এপ্রিল ২০২৩
৫৮ বছরেও নিশ্চিত হয়নি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা

বন্দর নগর চট্টগ্রামের একটি প্রাচীনতম শপিংমল বিপনী বিতান। এখানে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছেন অনেক ব্যবসায়ী। চারতলার এই মার্কেটে ৫১২টি দোকানে কয়েক হাজার মানুষ ব্যবসা করছেন। পাশাপাশি প্রতিদিন হাজারো ক্রেতার আনাগোনা এখানে। প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছর পার হলেও অগ্নিঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটটি।

নগরের ঐতিহ্যবাহী এই বিপনী বিতান বা নিউমার্কেট খ্যাত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু করে। ব্যবসায়ীরা এখানে থান কাপড়, তৈরি পোশাক, শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রিপিস, জুয়েলারি, কসমেটিকস, ঘড়ির দোকান, জুতা, তৈরি পোশাক ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান চারতলার কিছু কক্ষ পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। 

সরেজমিনে দেখা

সোমবার (১৭ এপ্রিল) চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ মার্কেটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় আতঙ্কিত এখানকার ব্যবসায়ীরাও। পুরো ভবনের কোন স্থানে দেখা যায়নি কোন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। পুরো মার্কেটজুড়ে কোথাও নেই ফায়ার হাইড্রেন্ট। অন্যদিকে গাদাগাদি করে সানসেটে বসানো হয়েছে এসির কমপ্রেসার। সে সঙ্গে মার্কেটের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে তারের ঘিঞ্জি। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন— রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে সম্প্রতি আগুন লাগার ঘটনায় তারাও উদ্বিগ্ন। প্রতিটি দোকানে অগ্নিনির্বাপক বসানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউমার্কেটের এক ব্যবসায়ী সিভয়েসকে বলেন, বিপনী বিতান হলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যুগ যুগ সময় পার হয়ে গেছে অথচ পুরো মার্কেটটিই অগ্নিঝুঁকিতে থেকে গেল। যদি এখানে কখনো আগুন লাগে যেকোন ব্যবসায়ী পথে বসা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। অথচ প্রতিটা ব্যবসায়ী ব্যাংক লোন বা ধারদনা করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

বিপনি বিতান মার্চেন্ট ওয়েলফেয়ার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ খোরশেদ আলম সিভয়েসকে বলেন, এটা ঠিক যে আমাদের বিপনী বিতানে অগ্নি নির্বাপনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। দোকানগুলোতে  ফায়ার এক্সটিংগুইশার লাগানো হয়নি। আমরা চাই না ঢাকার মত ঘটনা চট্টগ্রামে হোক। আমাদের ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ুক, দেউলিয়া হোক। কিন্তু বিপনী বিতানে দুটি রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে। সেটা দিয়ে প্রাথিমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। তবে আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা প্রতিটি দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসাবো।

ঝুঁকিতে রিয়াজুদ্দিন বাজার, হকার মার্কেট ও টেরিবাজার 

নিউমার্কেটের একপাশে হকার মার্কেট, বিপরীতে রিয়াজুদ্দিন বাজার। দুই কিলোমিটার দূরে টেরিবাজার। সেখানকার চিত্রও প্রায় একই। নেই আগুন কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। সরু সড়ক, পানির ব্যবস্থা না থাকার মত নানান সীমাবদ্ধতা তো আছেই।

সরেজমিন ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হকার্স মার্কেটের অন্তত এক হাজার ২০০ দোকান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। রেয়াজউদ্দিন বাজারের সব মার্কেটের দোকানদার ও কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। প্রতিদিন কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয় সেখানে। অথচ কোনো দোকানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। বিপজ্জনকভাবে রয়েছে বৈদ্যুতিক লাইনগুলোও। একসাথে জড়িয়ে রয়েছে টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার। তামাকুমণ্ডি লেইনে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা এবং অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থাও নেই।

চট্টগ্রামে যত অগ্নি দুর্ঘটনা

২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর মাসে জহুর হকার্স মার্কেটে আগুন লেগে পুড়ে যায় শতাধিক দোকান। ক্ষয়ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকার। একই বছর খাতুনগঞ্জের ভেড়া মার্কেটে আগুন লেগে ৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুড়ে যায় ২০০ দোকান। ২০২০ সালে ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রিয়াজুদ্দিন বাজারের হোটেল সফিনায় ও ২০২১ সালে আবারো জহুর হকার্স মার্কেটে আগুন লাগলে ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ অর্থের। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রিয়াজুদ্দিন বাজারের নূপুর মার্কেটের সপ্তম তলায় জুতার দোকানে সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। 

অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ১৬ মার্কেট

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের তালিকায় বড় ধরনের অগ্নি ঝুঁকিতে থাকা মার্কেটগুলো হচ্ছে- খাতুনগঞ্জ, জহুর মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমণ্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরু মিয়া মার্কেট, নূপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড় পুল বাজার, ইসা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্লাতলি বাজার।

টনক নড়েছে বড় বিপনি বিতানের

বছরের পর বছর অবহেলার পর মিমি সুপার মার্কেট, ফিনলে স্কয়ার, আমিন সেন্টার, আখতারুজ্জ্মান সেন্টারসহ বড় বড় শপিংমলগুলোতে সম্প্রতি টনক নড়েছে। সেখানে সরেজমিনে গিয়ে শপিংমলের প্রতিটি দোকানের পাশে দেখা গেছে একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। ফায়ার সার্ভিস বলছে, আখতারুজ্জামান সেন্টার আগে থেকেই নিয়ম মেনে আসছে। অন্যান্য মার্কেটগুলো দফায় দফায় নোটিশ দেয়ার পর কয়েকদিন আগেই বড় বিপনি বিতানগুলোতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ। 

ফিনলে স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আসাদ ইফতেখার সিভয়েসকে বলেন, সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় আমরাও চিন্তিত। আমরা নিজেদের ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সব সময় প্রাধান্য দেই। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আমাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। সেভাবে আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছি।  

ফায়ার সার্ভিস যা বলছে

পূর্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও সরু গলি ও জলাধার না থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার বেশ সময় লাগে। ফলে বিভিন্ন মার্কেট বা শপিংমলগুলোতে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে। এতে করে অধিকাংশ পণ্যই আগুনে পুড়ে যায়। আর ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল হালিম সিভয়েসকে বলেন, চট্টগ্রামের টেরিবাজার, নিউমার্কেট, তামাকুমণ্ডি, জহুর হকার্স ও শপিংমলগুলোতে দফায় দফায় চিঠির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে সজাগ করেছি আমরা। গত এক সপ্তায় এসব প্রতিষ্ঠানে আমরা ভিজিট (পরিদর্শন) করেছি। কিন্তু তারপরও আমরা তাদের কাজে কোন পরিবর্তন দেখিনি। অধিকাংশ মার্কেটে ব্যবসায়ীদের গুদাম রয়েছে। অনেক মার্কেটে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই, ইমারজেন্সি এক্সিট (তাৎক্ষণিক বের হওয়া) ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে এখনো প্রায় মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়