‘কর্ণফুলী টানেলের মূল চ্যালেঞ্জ দুই টিউবের ইন্টারকানেকশন’
সিভয়েস প্রতিবেদক
ছবি: সিভয়েস
কর্ণফুলী নদীর দুপাড়কে তলদেশ দিয়ে এক করতে যে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে, তার একটি টিউবের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে অনেক আগে। এখন অপর টিউবটিও আলোর মুখ দেখছে আগামীকাল শুক্রবার। একথা বেশ কদিন আগেই জানিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তবে মূল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭৩ শতাংশ। ফলে স্বপ্নের এই টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।
যদিও প্রকল্প পরিচালকের মতে, টানেলের ২টা টিউবের মধ্যে ইন্টারকানেকশন করার কাজটিই চ্যালেঞ্জিং ওয়ার্ক এবং সেটা সম্পন্ন হলেই বোঝা যাবে নির্ধারিত সময়ের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে কি যাবে না।
বৃহস্পতিবার নিজ অফিসে কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘আসলে আমাদের তো অ্যাক্সপজিশনের কাজ শেষ হচ্ছে। এখানে মনে করেন কোনো গাড়ি তো যেতেই পারবে না। কেউই যেতে পারবে না। সেটা একটা মানুষও যদি হয় তাও ৭৫ দিন সময় লাগবে। কারণ ওই টিবিএমটা এখনও ভেতরে আছে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে বের হবে। সেটা বের হয়ে ডিসপেন্টাল করে আস্তে আস্তে এটা ইরেকশন করা হয়েছিলো। একইভাবে সেটা ডিসপেন্টাল করে আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তারপর স্পেস পাওয়া যাবে। তারপর সেটা আমাদের যে ল্যান্ড স্ল্যাপের কাজ হবে সেটার কাজ পূরণ হবে। সুতরাং এখানে খুলে দেওয়ার মতো কিছু নয়। সব মিলিয়ে আমাদের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হচ্ছে ৭৩ শতাংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেগমেন্ট সম্বন্ধে বলতে গেলে সব সেগমেন্ট এসে গেছে বিধায় আমাদের খনন কাজ শেষ হয়ে গেছে। খনন কাজ শেষ হওয়া মানে সেগমেন্টের কাজ শেষ। আমি বলছি আমাদের ২টা যে মেইন টিউবের কাজ। ১ম টিউবের মধ্যে আমাদের যে স্ক্যাপেশন কাজ শেষ হয়েছে গত বছর আগস্টের ২ তারিখ। এ পর্যন্ত আমরা সেই ২৪৫০ মিটারের মধ্যে ১৬৬০ মিটার ল্যান্ড স্ল্যাপের কাজ সম্পন্ন করেছি। এই ল্যান্ড স্ল্যাপ সম্পন্ন হওয়ার পরে আরও কাজ আছে সেটা হচ্ছে সেগমেন্ট হবে দুই দিকে আমাদের রেডি ওয়ার্কস আছে। আরও অর্নামেন্টাল ওয়ার্কস আছে। আর আমাদের যে টিউবের কাজ আজকে স্ক্যাপেশনের কাজ সম্পন্ন হলো। সেটা মানতে গিয়ে আবার আমাদের সেটার ল্যান্ডস্লেপ কাজ শুরু করতে আমাদের প্রায় ২ আড়াই মাস সময় লেগে যাবে। কারণ ওই টিউবের টিবিএম দিয়ে কাজ সম্পন্ন হবে সেটা আস্তে আস্তে বের হবে। সেখানে সেটাকে ডিস পেন্টেরিং করে আবার প্রিপারেশন নিয়ে সেখানে ১ম টিউবের মতো ল্যান্ড স্ল্যাপের কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের টার্গেট হচ্ছে জানুয়ারি থেকে এই কাজ শুরু করা।’
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আমাদের ভাইডাক্টের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এটার মধ্যে শুধু এ্যাসফল্টের কাজ সেটা বাকি রয়ে গেছে। আমাদের কাজসমূহ চলতেছে এবং সেটাও আমরা সব মিলিয়ে আমাদের যে টার্গেট ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস। সেই সময়ের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ প্রকল্প শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি যেটুকু বলতে চাই, আগে শেষ করতে পারলে ভালো। তবে আমাদের টার্গেট হচ্ছে যেহেতু আমাদের ২টা টিউবের মধ্যে ইন্টারকানেকশন করতে হবে। যেটা আমরা ক্রস বেসিস বলি। এটাই হচ্ছে এখনও চ্যালেঞ্জিং ওয়ার্ক এবং সেইটা সম্পন্ন হলে পরেই আমি বুঝতে পারবো যে আমরা আমাদের নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ করা যাবে কি যাবে না। এইটার উপর নির্ভর করছে এবং সেইজন্যে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে যে আমাদের নির্ধারিত যে সময় আছে তার মধ্যে শেষ করা। আমি যেহেতু এখানে কাজ করছি ২/৩ বছর যাবত আমি অত্যন্ত বলতে পারি প্রকল্পের কাজ যথেষ্ট সময়ের আগে শেষ হবে।’
প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আর প্রকল্পের ব্যয় যেটা বলছেন, যেহেতু এইখানে আমাদের সাথে জি টু জি কন্টাক্ট চাইনিজদের সাথে, এটা কোনো টাকার কন্টাক্ট না। এটা হচ্ছে সেভেন হান্ড্রেড ফাইভ মিলিয়ন এইট ডলারের চুক্তি। সেভেন হান্ড্রেড ফাইভ মিলিয়ন এইট ডলার কিন্তু ঠিক থাকছে, কিন্তু যখন আপনি এটাকে ট্রান্সফার করতে যাচ্ছেন। আগে সেভেন হান্ড্রেড ফাইভ পয়েন্ট এইট মিলিয়ন ডলার সমান হয়েছিল মনে করেন ৪ হাজার ৯শ কোটি টাকা। এক পাওয়ার পর যখন প্রথম রিভার্স করছি তখন পেয়েছি ৫হাজার ৯শ ১৩কোটি টাকা। তখন ডলারের রেইট ছিলো ৭৭.৭৮ টাকা। এখন আমাদের ফাইনাল একটা রিভার্স করতে হবে মূল্য ৭০৫.৮মিলিয়ন ঠিকই আছে কিন্তু এখন যদি রিভার্স করতে যান ৮০৫.৭৮ অর সামথিং আরও সামনে আরও বাড়তে পারে। এমনেও তো সেটা আমাদের মূল মূল্য ঠিক আছে কিন্তু ইন ট্রান্স ফ্রম মানি সেটা ডলারের রেট দ্বারা কিছুটা বাড়তি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপে আমাদের কিছু সমস্যা হয়ে গেছে। এরমধ্যে আমরা এখনও চেষ্টা করছি। একটা জিনিস আমি বলতে পারি, ক্রসবেসিসে যে কাজটুকু করতে হবে সেখানে যে যারা এক্সপার্ট চায়না থেকে আসবে। এখন কিন্তু যতটুকু জানি এখন পর্যন্ত মাসে প্রায় ১টা ফ্লাইট আছে বোধহয় চায়না থেকে। সুতরাং সেই এক্সপার্টরা আসতে হবে। তো এ সমস্ত কারণে এটা আমি জটিলতা বলবো না। সেটা তারা আসলে পরে আমরা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবো। আর জটিলতা বলতে আমি যেটা বলতে চাই— যেটা আমাদের ল্যান্ড দরকার। আমাদের দেশে ল্যান্ড এর যে সমস্যা সেটা কিন্তু আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের জেলা প্রশাসনের যথেষ্ট সহায়তায় আমরা সেটা ওভারকাম করতে পেরেছি। এরকম কোনো জটিলতা আর আমাদের নেই।’
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাসভিত্তিক প্রতিবেদন অনুসারে, টানেল নির্মাণকাজের এখনো বাকি ২৭ শতাংশ। দুটি টিউবের নির্মাণকাজ শেষে ভায়াডাক্ট, অ্যাপ্রোচ সড়ক, টানেলের অভ্যন্তরে সড়ক নির্মাণ, পিচ ঢালাই, ইউটিলিটি সার্ভিস সংযোজন, তিনটি ক্রসিং প্যাসেজ সংযোজন করবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া শতভাগ ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করে সার্ভিস এরিয়া ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হবে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল হতে পারে বলে আশা করছে সেতু বিভাগ।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ২ আগস্ট প্রথম টিউবের বোরিং কাজ আনোয়ারা প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়। অর্থাৎ এক বছর ছয় মাস লাগে প্রথম টিউবের রিং প্রতিস্থাপনে। প্রায় সাড়ে চার মাস পর বোরিং মেশিনটি সরিয়ে আনোয়ারা প্রান্ত থেকে দ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হয়। প্রথম টিউবের চেয়ে কম সময়ে শুক্রবার দ্বিতীয় টিউবের কাজ শেষ হতে যাচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় টিউবের ২ হাজার ৪৪০ মিটার বা ৯৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৯ মাসে দ্বিতীয় টিউবের রিং প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ করেছে। মূলত প্রথম টিউবের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় টিউবের কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে পেরেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার করে সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি ওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারে এ টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে। বর্তমানে দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের পাশাপাশি প্রথম টিউবের অভ্যন্তরীণ স্ট্রাকচারের কাজ চলমান। প্রথম টিউবের ১ হাজার ৬২৩ মিটার (৬৬ দশমিক ২২ শতাংশ) লেন স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক, যার সুদহার ২ শতাংশ। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার হলেও মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলের ব্যাস ৩৫ ফুট ও উচ্চতা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অন্য টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব প্রায় ১২ মিটার। টানেল দুটির মধ্যপথে তিনটি কানেকটিং প্যাসেজ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জরুরি প্রয়োজন কিংবা অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ চলাকালীন একটি টিউব থেকে অন্য টিউবে এসব প্যাসেজ দিয়ে যানবাহন/প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চলাচল করতে পারবে।