মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস : জঙ্গল সলিমপুরের ভূমিদস্যুদের কাছে জিম্মি প্রশাসন!
সিভয়েস প্রতিবেদক
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বসবাসরত বাসিন্দারা রয়েছেন চরম জীবন ঝুঁকিতে।
সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে বেশ কয়েক দশক ধরে ঘর বানিয়ে বসবাস করে আসছেন বহু মানুষ। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বসবাসরত বাসিন্দারা রয়েছেন চরম জীবন ঝুঁকিতে। এক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল উঠছে প্রশাসনের দিকে। জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ে বিগত সময়ে জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদ পরিচালনা না করা ও নিশ্চুপ ভূমিকায় জন্ম দিয়েছে নানান প্রশ্নের।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে অনেকটা অসহায় থাকতে হয় জেলা প্রশাসনকে। যার কারণে সলিমপুর পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সম্পর্কে জানলেও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। শহরকেন্দ্রিক পাহাড়ে বসবাসরত বাসিন্দাদের অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা না নেওয়া নিয়ে নগরবাসী ও সচেতন মহলের অভিযোগ বহুদিনের।
অভিযোগের আঙুল উঠেছে সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসনের দিকেও। জীবন ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ে জনবসতি গড়ে উঠলেও হাতেগোনা কয়েকটি অভিযান চালিয়েই দায় সারছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। যদিও উপজেলা প্রশাসন বলছে, শিগগিরই জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনার চিন্তা করছেন তারা। আর জেলা প্রশাসনের ভাষ্য মতে, উপজেলা প্রশাসন সাহায্য চাইলে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত তারা।
জানা যায়, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বিভিন্ন পাহাড়ের ৮টি পাড়ায় ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। বসবাসকারীদের অধিকাংশই গার্মেন্টস কর্মী, দিনমুজুর ও সিএনজি-অটোরিকশা চালক। তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। স্থানীয় ছিন্নমূল সমবায় সমিতি এবং আলীনগর সমবায় সমিতিসহ এমন আরও বেশ কিছু সমিতির ছত্রছায়ায় সলিমপুরের পাহাড়ে এসব অসহায় মানুষেরা বসবাসের সুযোগ পান বলেও জানা গেছে।
সরেজমিনে জঙ্গল সলিমপুরের, ছিন্নমূল, বরইতলা, তালতলা ও জলিল পাড়ার বেশকিছু পাহাড় পরিদর্শন করে দেখা যায়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অসংখ্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড় কেটে তৈরি করা এসব ঘরবাড়ির অধিকাংশই নির্মাণ করা হয়েছে ঠুনকোভাবে। মাঝারি আকারের গাছ কেটে সেগুলো মাটিতে পুঁতে দিয়ে তারপর টিন জড়িয়েই তৈরি করা করা হয়েছে বেশিরভাগ ঘর। যেকোনো মুহূর্তে এসব ঘর ভেঙে ঘটতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা।
স্থানীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান, জঙ্গল সলিমপুরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নিয়মিত চলে পাহাড়ের জায়গা বেচাকেনা। স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতির নামে গত দুই দশকে অসংখ্য সরকারি পাহাড়ি জায়গা অবৈধভাবে দখল সূত্রে বিক্রি করে আসছেন।
উপজেলা প্রশাসন এসব জেনেও কোন পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগও করেন স্থানীয়রা।
তবে এসব এলাকার প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দারা অসম্মতি জানান। কারণ হিসেবে তারা জানান, এদের (ভূমিদস্যু) বিরুদ্ধে মুখ খুলা তাদের জন্য নিরাপদ নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, বরইতলা ২ নম্বর পাড়ার সভাপতি আলী এরশাদ, সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, তালতলার সভাপতি মো. মুনশি ও সেক্রেটারি মো. শামীম প্রকাশ কেরাটি শামীম এবং জলিল পাড়ার সভাপতি হানিফ মাঝি ও সেক্রেটারি সেলিম হোসেন পাহাড়ে টাকার বিনিময়ে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেন। তাদের ইশারায় বেচা-কেনা হয় বড় বড় পাহাড়।
এদিকে, পাহাড়ে বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দার সাথে কথা হলে তারা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান প্রতিবেদককে। জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল বস্তি এলাকার বাসিন্দা মো. ইয়াকুব আলী সিভয়েসকে বলেন, ‘নিজেদের কোনও জায়গা নাই। তাই জীবন ঝুঁকি আছে জেনেও পাহাড়ে বসবাস করতে হচ্ছে। তবে, সমতল ভূমিতে আমাদের থাকার জায়গা দিলে আমরা সেখানে চলে যাব।’
পাহাড়ে বসবাসরত বাসিন্দাদের সাথে কথা হলে তারাও একই কথা জানান। তাদের মতে, অনেকটা বাধ্য হয়েই পাহাড়ে থাকছেন তারা। যদিও কে বা কারা তাদের পাহাড়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সে বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি কেউই।
সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাশেদুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ‘সরকারি খাস জায়গা আসলে অবৈধভাবে ভোগ ও ক্রয়-বিক্রয় করার অধিকার কারও নেই। তবে জঙ্গল সলিমপুরে কার্যকর অর্থে আমাদের তেমন কোনও অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। যদিও আমরা বেশ কয়েকদিন ধরে এসব বিষয়কে চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই এলাকাগুলোতে বিভিন্ন সমিতি ও বেশ বড় সংখ্যার জনবসতির কারণে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এই বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ কথা জানাবেন বলে বলেছেন।’
অন্যদিকে, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘এটা আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানবেন। এ বিষয়ে আমরা তাদের নির্দেশনা দিব। যদি উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা চায় তাহলে আমরা সহযোগিতা দিবো।’
তবে, এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে একাধিকার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
-সিভয়েস/জেআইএস