পণ্যের দাম না বাড়াতে ম্যাজিস্ট্রেটের ‘অনুরোধ’

মিনহাজ মুহী, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ২২:১৪, ২০ এপ্রিল ২০২৪
পণ্যের দাম না বাড়াতে ম্যাজিস্ট্রেটের ‘অনুরোধ’

পেঁয়াজ, আলুর দামে যখন অস্থির চাক্তাই- খাতুনগঞ্জের বাজার ঠিক তখনই অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম না বাড়াতে ব্যবসায়ী নেতাদের ‘অনুরোধ’ জানিয়ে এলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট! শনিবার (২০ এপ্রিল) পরিচালিত ওই অভিযানে নেতৃত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সম্পাদককে এ অনুরোধ জানান। তবে অভিযানে দুই প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে অভিযানে গিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম না বাড়াতে অনুরোধ জানানোর বিষয়টি ভালো ‘চোখে’ দেখছে না ভোক্তা-নাগরিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, এসব অভিযান লোক দেখানো। ‘অভিযান চলমান আছে’— বলতেই তাদের এ ধরনের অভিযান। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) অভিযানে গিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের বিষয়টি ‘দিনের সেরা কৌতুক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এফ এম শামীমের দাবি, ‘প্রেস রিলিজে যেভাবে লেখা হয়, আসলে সেভাবে বলা হয় না।’

ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর হঠাৎ করে চট্টগ্রামের বৃহত্তর পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ আলুসহ নিত্যপণ্যের দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ছুটি শেষে পঞ্চম দিনে খাতুনগঞ্জে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অভিযানে গিয়ে শুধুমাত্র ক্রয়-বিক্রয় রশিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি করার অপরাধে ২ ব্যবসায়ীকে কৃষি বিপনন আইন, ২০১৮ এর ধারা অনুযায়ী, ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি অযৌক্তিকভাবে দাম না বাড়ানোর জন্য বাজার সভাপতি -সম্পাদককে ‘অনুরোধ’ জানিয়ে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকাল ৩টা থেকে ৪টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত অভিযানে নেতৃত্ব দেন বাকলিয়া সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ. এফ. এম. শামীম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং কোতোয়ালী থানা পুলিশের একটি টিম। জেলা প্রশাসনের স্টাফ অফিসারের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

অভিযানে গিয়ে অনুরোধ জানানো মানে অনেকটা লোক দেখানো : ক্যাব

ভোক্তাদের জাতীয় সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সেভাবেই তিনি করেছেন। গত রমজান মাসে দুয়েকটা ছাড়া কোনো অভিযান ছিল না। আর দুই দোকানে (ব্যবসায়ী) জরিমানা করার জন্য কষ্ট করে সেখানে (খাতুনগঞ্জ) যাওয়ার দরকার ছিল না। এসব অনেকটা লোক দেখানো। মানে আমরা মাঠে আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘যেমন ডিসি (জেলা প্রশাসক) বলেন না— ‘আমাদের অভিযান চলমান আছে। তেমনি গণমাধ্যমে লিখতে সুবিধা হবে ম্যাজিস্ট্রেট খাতুনগঞ্জে গিয়েছিলেন; অভিযান চলমান আছে। তবে অভিযান কয়টি দোকানকে জরিমানা করেছে এবং কতদিনে করেছে।’ এগুলো জনগণকে বোকা বানানোর প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে এটা আন্তরিকতার ঘাটতি। এগুলো দিয়ে কোনো কাজ হবে না।’’

ক্যাব সহ-সভাপতি বলেন, ‘তারাও (ব্যববসায়ীরা) বুঝে গেছে। জেলা প্রশাসন কী চায়? তারা (ব্যবসায়ী) সে অনুযায়ী করে। এটাকে (অভিযান) তারা (ব্যবসায়ী) কোনো গুরুত্ব বা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এটা আসলে দুঃখজনক। আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষের যেসব বিষয়ে সমস্যা-কষ্ট সেসব বিষয়ে প্রশাসনের দায়িত্বরতরা এগিয়ে আসবেন; সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন— এটা জনগণ প্রত্যাশা করে।’

এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রতিদিন ডাল-চাল-তেল কিনতে হয়। প্রতিদিন যদি দাম বাড়ে তাহলে বাড়তি টাকা কোথা থেকে পাব। আমাদের বাঁচতে হবে। এটা আমার নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। ফুল উৎসবসহ অন্যান্য সবকিছুর আগে আমাদের বাঁচতে হবে। এটা যদি তারা করে তাহলে তাদের আমরা সাধুবাদ জানাবো।’

‘অভিযানে গিয়ে অনুরোধ’ —চট্টগ্রামে আজকের দিনের সেরা কৌতুক : সুজন

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রশাসন হচ্ছে ব্যবসায়ীবান্ধব। ব্যবসায়ীবান্ধব যেহেতু প্রশাসন, ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব সংখ্যাগরিষ্ট। এটা ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার, ব্যবসায়ীবান্ধব রাষ্ট্রতন্ত্র; সুতরাং তাদেরকে তোয়াজ করে চলা বরং মাঝে মধ্যে অভিযান চালায়, সেগুলো হচ্ছে ছোটখাটো চুনপুটি। এগুলো জনগণকে আইওয়াশ দেখানোর জন্য। জনগণ যেন প্রশাসনের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, সরকারের প্রতি, রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রতি একটু খুশি হয়। এটার জন্যই তামাশাটা করা হয়। এটা দিন শেষে কিন্তু নাগরিকদের জন্য তামাশাই। এটাতে কোনো রকম পরিবর্তন হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধরেন আজ (শনিবার) রিয়াজউদ্দিন বাজারে প্রতিকেজি আলুর দাম ৫০ টাকা। যদি তাদেরকে (ব্যবসায়ী) একটু রিকুয়েস্ট (অনুরোধ) করা হয় যে, দাম বাড়ায়েন না। তাহলে এটা হাস্যকর, এটা কৌতুক। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের দাম না বাড়াতে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুরোধ জানানোর ঘটনা চট্টগ্রামের জন্য আজকের দিনের সেরা কৌতুক।’

কৃষি বিপণনের ইস্যুকৃত সার্কুলারে দামের হেরফের খুব কম ছিল : ম্যাজিস্ট্রেট

অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে বাকলিয়া সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ. এফ. এম. শামীম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে বেসিকেলি (মূলত) আড়তদাররা বিক্রি করেন। আমার সঙ্গে ছিলেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা ১৫ মার্চের একটা ইস্যুকৃত দামের সার্কুলার নিয়ে গিয়েছিলেন। ওটার সঙ্গে দামের হেরফের খুব কম ছিল। আর আমরা যাওয়ার পর মূল্য তালিকা কেউ টাঙিয়েছেন কিনা সেটা শিওর (নিশ্চিত) করে বলতে পারবো না। তবে প্রত্যেকটি দোকানে দেখেছি, মূল্য তালিকা টাঙানো আছে। যে বিক্রি করছিল ক্রয় রশিদ তো পেয়েছি, দুটাতে পাইনি সেখানে জরিমানা করা হয়েছে। অন্যান্যগুলোতে ছিল। আর কৃষি বিপণণ অধিদপ্তরের ইস্যুকৃত দামের যে সার্কুলার ছিল, ওটার সঙ্গে এক-দুই টাকা এদিক-সেদিক।’

পণ্যের দাম উঠানামা নিয়েই শনিবারের অভিযান ছিল কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে পণ্যের দাম নিয়ে প্রকাশিত একটি নিউজ ডিসি (জেলা প্রশাসক) স্যার পাঠিয়েছিলেন।’ 

আলুর বাড়তি দামের কথা জানালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আলুর একটা পেয়েছি। ওটা ভারতীয় আলু ছিল। তারা সেটা প্রতিকেজি ৩৮ টাকা করে বিক্রি করছিল। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে এটা (দাম) ঠিক আছে।’

অভিযানে গিয়ে বাজার সমিতির সভাপতি-সম্পাদককে পণ্যের দাম না বাড়াতে ‘অনুরোধ’ জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আদেশ লিখলে সেটাতেও আপনারা যারা আছেন, আপনারা অনেক সময় বলেন আমরা মানুষজনকে আদেশ দিচ্ছি, ফোর্স করতেছি। এটা শুধু এ কারণে লিখা, বলার সময় এভাবে (অনুরোধ) তো বলা হয় না। আপনারা সেটা ভালোভাবেই জানেন। আড়তে ম্যাজিস্ট্রেট এবং আড়ত মালিক ছাড়া তো কেউ থাকে না। তাই অভিযোগ করার মতোও কেউ থাকে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আড়তে আপনারা যান, একটু দেখেন। তারা যে কমিশনের মাধ্যমে বিক্রি করছে এটা নিয়ে তো ক্যাব বা সুজনের কেউ কাজ করছে না। ওখানে তো কোনো দোকানদার কিনে এনে বিক্রি করছে না। সবাই কমিশন নিয়ে বিক্রি করছেন। এটা নিয়ে তো আপনারা নিউজ করছেন না, কাজ করছেন না।’

‘ব্যবসাটা যে বছরের পর বছর এভাবে চালাচ্ছে আপনাদের ভয়েসটা কোন জায়গায়? ‘আমি (ম্যাজিস্ট্রেট) আজকে গিয়ে যে সমস্যাটা দেখলাম, কমিশনে বিক্রি করা। ওরা জিনিসিটা কিনেও আনে না। গাড়িভাড়ার একটা স্লিপ দেখাই, কমিশনে বিক্রি করে এরপর এখান থেকে কমিশন পাই। এগুলো নিয়ে কাজ করেন আপনারা।’— বলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়