চসিক নির্বাচন
ভোটে নয়, জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে লড়ছেন ‌‌‘কাউন্সিলর’ সেলিম

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ৫ জানুয়ারি ২০২১
ভোটে নয়, জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে লড়ছেন ‌‌‘কাউন্সিলর’ সেলিম

‘কাউন্সিলর’ সেলিম জীবনের কাঁটাকণ্টক পথ পেরিয়ে এখন লড়ছেন মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে।

জীবন মানে সম্পর্ক, প্রাণের সঙ্গে প্রাণের, সমাজের সঙ্গে অস্থিত্বের। আর সমাজ দূষিত হয়ে গেলে কেউ একা ভালো থাকতে পারে না। সবাইকে নিয়েই তো বেঁচে থাকা।—এই মন্ত্র ধারণ করেই সারাজীবন এগিয়ে গেছেন ‘কাউন্সিলর’ তারেক সোলেমান সেলিম। প্রাণে উচ্ছ্বাস আর বুকভরা সাহস—তাতে ভর করে বারবার লড়েছেন নানা নীলনকশার বিরুদ্ধে। বাঘের হুংকারে কুপোকাত করেছেন প্রতিপক্ষকে। আর এসব করতে গিয়ে বারংবার জুটেছে অকথ্য নির্যাতন, জেল-জুলুম আর সমালোচনা। জীবন নামের পাণ্ডুলিপিতে যোগ করেছেন টানা চারবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার কৃতিত্বও। 

এক সময়ের তুখোড় এ ছাত্রনেতার আগের জৌলুস এখন আর নেই। জীবনের কাঁটাকণ্টক পথ পেরিয়ে এখন লড়ছেন মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন নিজের প্রাণপ্রিয় শহর থেকে দূরে ভারতের এক হাসপাতালে। অথচ এখন তার গলাভরা সেই আওয়াজ থাকার কথা ছিল ভোটের মাঠে। মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে স্বভাবসূলভ মিষ্টি হাসিতে ভোট প্রার্থনার।  

অবশ্য সহযোদ্ধাদের আক্ষেপ—আসন্ন চসিক নির্বাচনে ব্যক্তিবিশেষের আক্রোশে দলীয় মনোনয়ন পাননি তারেক সোলায়মান সেলিম। তাতে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয় এই নেতা। কিন্তু চুপ করে বসে থাকেননি। সাহসী এ যোদ্ধা বরঞ্চ চসিকের ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের শপথ শুনিয়েছিলেন—অগণিত ভক্তদের মাঝে আবারও ফিরবেন কাউন্সিলরের বেশেই। ‘কাউন্সিলর’ সেলিমের সেই ঘোষণায় সবাই একাট্টা হয়ে বেঁধেছিলেন জোটও। 

আফসোস, নিজ দলের মত নিয়তিও যেন ‘বঞ্চিত’ করেছে তাকে। দেহে যে তার বাসা বেঁধেছে মরণব্যাবি বোন ক্যানসার। ভোটের ময়দান থেকে ফেরত গিয়ে রাজপথের লড়াকু সৈনিক এখন লড়ছেন জীবনের প্রলয় ঠেকাতে! তারেক সেলিমের ছোটভাই তারেক ইফতেখার সিভয়েসকে বলেন, ‘এখন আর ভোট নয়, ভাইয়ের (তারেক সোলেমান সেলিম) জীবন বাঁচানো হলো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।’ 

জীবনের গল্পটা যেন এক মুকুটহীন রাজার 

সময়টা ১৯৯০ সাল। আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের মুখে নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জীবন রক্ষায় চট্টগ্রামের আলকরণ ওয়ার্ডে ঘরছাড়া হন তারেক সোলেমান সেলিমরা চার ভাই। রাজপথে থেকে অলিগলি ঘুরে ঘুরে নির্ঘুম কাটছিল রাতের পর রাত। তাদের অপরাধ আওয়ামী লীগের ডাকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া।

পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর বাড়ি ফিরেন সেলিমরা চার ভাই। সেদিন মমতাময়ী মা ফেরদৌস আরা বেগম সন্তানদের কাছে পেয়ে বলেছিলেন— ‘এরশাদ ফল (পতন) করেছে। আমি যতটা না... খুশি হয়েছি। আমার বড় আনন্দ, এখন থেকে আমার চার ছেলে বাসায় ঘুমোতে পারবে।’ 
স্থানীয়রা অবশ্য বলছেন, আগাগোড়া আওয়ামী লীগ পরিবার হওয়ায় এদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ঝঞ্ঝার ছোট্ট একটি নিদর্শন মাত্র এই ঘটনা।

তারেক সোলেমান সেলিমের বাবা মোহাম্মদ সালেহ ছিলেন আলকরণ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রস্তুতি মিটিং— এসবের সবই হয়েছিল সালেহর বাড়ি থেকেই। মুক্তিযুদ্ধকালীন এ বাড়িতেই চলতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। পরে পুরো ট্রেনিং নিতে সেখান থেকে ভারতে যেতেন যোদ্ধারা। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন ‘সিটি আওয়ামী লীগে’র (বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগ) সহ-সভাপতির দায়িত্বে থেকে মৃত্যুবরণ করেন মোহাম্মদ সালেহ।

বাবা-মায়ের সান্নিধ্যেই রাজনীতিতে হাতেকড়ি তারেক সোলেমান সেলিমের। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদ আর আক্রোশ নিয়ে তিনি নেমে পড়েছিলেন রাজপথে। সৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কিংবা এক-এগারোর সময় আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সামনের সারিতে। 

আওয়ামী লীগের বিপদের পরম বন্ধু আলকরণ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে পচাত্তর পরবর্তী সময়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন। পরে সিটি কলেজ ও মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করেছেন। 

সেলিমের ভাই তারেক ইফতেখার সিভয়েসকে বলেন, ‘এরকম গল্পতো বলে শেষ করা যাবে না। তবে ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামী লীগের মিছিলে হামলা করেছিল সন্ত্রাসীরা। আটকে রাখে তৎকালীন উত্তর জেলা সভাপতি এমএ ওয়াহেব, দক্ষিণ জেলার নেতা এমএ সালেহ এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে। এই তিন নেতাকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচাতে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারেক সোলেমান সেলিমসহ আরও ২৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। পাল্টা হামলা করে নেতাদের উদ্ধার করেন।’

এছাড়াও তারেক সোলেমান সেলিম কয়েকবার হামলার শিকারও হন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের নির্মম ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতারও হন। বিরোধী পক্ষের শত অত্যাচার-নির্যাতন সয়েও চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি দলের আদর্শ ও নীতি থেকে। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তারেক সোলেমান সেলিম। এরপর ২০০০, ২০০৪ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

সেলিমের সহযোদ্ধারা জানান, টানা চারবারের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েও টাকার দিকে নজর দেননি তিনি। এতটুকু বদলায়নি জীবনের ধারা। তার সাদাসিদে যাপন থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। এমনকি মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার খরচ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তাকে খোলা চিঠিও লিখতে হয়েছে। যদিও জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসাব কষতে নারাজ তার পরিবার।

তারেক সোলায়মান সেলিমের সাদাসিদে জীবনের বর্ণনা দিয়ে কাউন্সিলর পদে আরেক মনোনয়ন বঞ্চিত আলম দিদার বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে মনোনয়নের জন্য আমি যেমন ঢাকায় তেমনি সেলিম ভাইও গিয়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে উনি রামপুরায় তার যে আত্মীয়ের ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে উঠেছেন সেখানে আমিও উঠেছিলাম। আমরা টানা ৭ দিন মনোনয়ন সংগ্রহ, জমাদান, গণভবনে যাওয়া; পরের তিন দিন সিনিয়র নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতেই চলে যায়। উনার সাথে আমার তেমন ঘনিষ্টতা না থাকলেও ওই সময় উনি আমাকে খুব আপন করে নেন। মাঝরাতে গল্প করতে করতে নিজ হাতে চা বানিয়েও খাওয়াতেন।’

‘নগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও আলকরণ ওয়ার্ড থেকে বারবার নির্বািচিত কাউন্সিলর হলেও উনি ওই ব্যাচেলর বাসাতেই থেকেছেন। অথচ নতুন মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকে বা সদ্য সাবেক কাউন্সিলরদের অনেককে দেখেছি দামি গাড়িতে করে ঢাকার রাজপথে ঘুরছেন তখন। আর উনি সিএনজি অটোরিকশায় চড়েছেন আর রাতে এসে ব্যাচেলর বাসায় ঘুমিয়েছেন। উনার সাথে রাতে আড্ডায় বসলে বুঝতাম উনি জীবনকে খুব সাধারণভাবেই উপভোগ করতেন। যখন মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে দুজনেই বাসায় এসে মিলিত হলাম, তখন দেখেছি শতশত ফোন কল আসছিল তার কাছে। সবার অনুরোধ নির্বাচন করতেই হবে। হয়তো সেকারণেই তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে এখন ভোটযুদ্ধে নয় জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে লড়তে হচ্ছে।’ 

-সিভয়েস/এপি

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়