৪১ বছরে প্রাণ গেছে ২৯ ফায়ার ফাইটারের, বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের ভুলে একদিনেই ১২ জন

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:২৩, ৮ জুন ২০২২
৪১ বছরে প্রাণ গেছে ২৯ ফায়ার ফাইটারের, বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের ভুলে একদিনেই ১২ জন

চট্টগ্রামে গত পাঁচ বছরে ৪টি কেমিক্যাল কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসকে আগে থেকে রাসায়নিকের তথ্য জানানো হয়েছিল। যে কারণে কেমিক্যাল কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। এমনকি সেখানে কোনো ধরনের হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই রাসায়নিকের তথ্য গোপন রাখায় হারাতে হয়েছে ১২ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীকে। এরমধ্যে দশজনের মরদেহ মিললেও একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আরও দুইজন। এর বাইরে আহত হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৮ জন ফায়ার ফাইটার। শুধুমাত্র ভুল তথ্যের কারণে অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে একসঙ্গে এতোজন ফায়ার ফাইটারদের নিহত হবার ঘটনা এবারই প্রথম। 

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে একটি এবং তার তিন বছর পর ২০২১ সালে আরও তিনটি কেমিক্যাল কারখানায় আগুন লাগে। তারমধ্যে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর সিইপিজেডের মিতুন নীটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেড নামের এক কেমিক্যাল কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের এক ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সেসময় কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। 

এরপর ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর সদরঘাটের মাঝিরঘাটে, ১৪ নভেম্বর সিইপিজেডের কেএনটি কনটেইনার ডিপোতে, ও ২৬ নভেম্বর সাগরিকার হোমল্যান্ড কেমিক্যাল কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। তবে এরমধ্যে সাগরিকায় আগুন নেভানোর পর অসুস্থ হয়ে এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ঘন্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।

অথচ গত ৪ জুন সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম কনটেইনার ডিপোতে গার্মেন্টস পণ্য ভর্তি কনটেইনারে আগুন লেগেছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ শুরু করে ফায়ার ফাইটাররা। পরবর্তীতে সেখানে কেমিক্যালের বিস্ফোরণ ঘটে ৪৫ জনের প্রাণহানি হয় এবং আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। যদিও ফায়ার সার্ভিসের দেড় শতাধিক সদস্যের প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ হ্যাজমাট (বিপজ্জনক উপাদান) টিম রয়েছে। যারা কেমিক্যালসহ রাসায়নিক বিস্ফোরণের মতো ঘটনায় কাজ করে থাকেন। কিন্তু ডিপো কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও তথ্য গোপন রাখার খেসারত জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে সাধারন মানুষ ও ফায়ার কর্মীদের। ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ প্রাণদানের ঘটনা। 

জানা যায়, ১৯৮১ সালের ৯ই এপ্রিল তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তর সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন ২৯ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। 

২০২২ সালের ৪ জুন শুধু সীতাকুণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন সদস্য। তারমধ্যে দশজনের মরদেহ মিললেও একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আরও দুইজন। নিহতরা হলেন- ফায়ার ফাইটার মো. রানা মিয়া, নাসিং মনিরুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার আলাউদ্দিন, ফায়ার ফাইটার মো. শাকিল তরফদার, লিডার মিঠু দেওয়ান, ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম, লিডার নিপন চাকমা, ফায়ার ফাইটার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও লিডার মো. ইমরান হোসেন মজুমদার। নিখোঁজ রয়েছেন ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান।

এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৮ জন ফায়ার কর্মী। তারা হলেন— সিনিয়র স্টেশন অফিসার সুলতান মাহমুদ, ফায়ার ফাইটার জিয়াউর রহমান, হাবীবুর রহমান মিঝি, আসাদুর জামান, রবিন মিয়া, গাউসুল আজম, সাব অফিসার আব্দুল মন্নান, ড্রাইভার মো. শাহ জালাল, মো. সোহেল রানা, ফায়ার ফাইটার রাকিব হাসান বাপ্পি, ড্রাইভার চান মিয়া, ফায়ার ফাইটার মো. রাসেল রানা, মো. তাইবুর রহমান, মো. শাকিল খান, নুর ইসলাম, ড্রাইভার পিঙ্গল বাড়ৈ, নুর হোসেন ও মো. রায়হান পাট্টাদার।

কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মবিলাইজিং অফিসার কপিল উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘গত ৫ বছরে রাসায়নিকের আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে চারটি। প্রত্যেকবারই আমাদেরকে আগে থেকে জানিয়ে ছিল যে সেখানে রাসায়নিক ছিল। আমরা সেভাবেই আগুন নির্বাপণ করতে গিয়েছিলাম। প্রায় সব গুলোতেই ঘন্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এবারের ঘটনায় মালিকপক্ষ শুরুতেই ভুল তথ্য দিয়েছিল। যার কারণে আমাদের ১২ সহকর্মীকে হারিয়েছি। তারা যদি শুরুতে সঠিক তথ্য দিতেন তবে এমন ভয়াবহতা আমাদের দেখতে হতো না।’

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন শিকদার সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা ছোট বড় অসংখ্য আগুনের ঘটনা মোকাবিলা করেছি। তারমধ্যে কেমিক্যাল কারখানার আগুনও ছিল। কিন্তু এতো বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি কখনো হয়নি আমরা। শুরুতেই যদি আমাদের জানানো হতো সেখানে রাসায়নিক আছে তাহলে আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে যেতাম। শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না করায় আমাদের ১২ জন সদস্যকে হারিয়েছি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে সকলের প্রতি আহবান থাকবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত চলছে। তদন্তে কাদের কাদের অবহেলা ছিল সব উঠে আসবে। আর প্রতিবেদন হাতে পেলে দায়ী ও দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

অন্যদিকে, চট্টগ্রামে গত ৫ বছরে ছোট-বড় অন্তত সাড়ে তিন হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৯ জন এবং আহত হয়েছেন ১০৮ জন। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। তবে চলতি বছরের জুন মাসে সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহত ও নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে গত পাঁচ বছরকেও। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের (আগ্রাবাদ অফিস) ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়