Cvoice24.com

মিল মালিকদের কব্জায় চালের বাজার, বিক্রি কমলেও দাম উর্ধ্বগতি 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৩ মার্চ ২০২১
মিল মালিকদের কব্জায় চালের বাজার, বিক্রি কমলেও দাম উর্ধ্বগতি 

চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কমলেও দাম কমেনি।

দীর্ঘ তিনমাসেরও বেশি সময় ধরে অস্থির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চালের বাজার। এদিকে স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানিও বেড়েছে আগের তুলনায়। খাদ্য মন্ত্রীর আশ্বাসের পরও দাম কমার পরিবর্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। মিল মালিকরা প্রতিবেশী দেশ থেকে চাল এনে বাজারে সীমিত আকারে ছাড়ছেন। ফলে আমদানির পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। এর প্রভাবে চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কমে গেছে বিক্রি। দাম কবে নাগাদ কমতে পারে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই পাইকারদের কাছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।  

পাইকারী ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কুষ্টিয়া জেলার ৪৬ অটো চালকল মালিক। প্রতি বছর এ সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়ে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা আর নানা সুযোগে চালের বাজারকে অস্থির করে তুলছে এই সিন্ডিকেট। এসব মিলে অন্তত ৫০০ মেট্রিক টন চালও মজুত আছে। তাছাড়া নামে বেনামে সরকারের কাছ থেকে চাল আমদানির বরাদ্দপত্র নিয়েছে বড় বড় চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা। আবার ছোট-খাট যে সকল ব্যবসায়ী বরাদ্দপত্র পেয়েছে সেগুলোও তারা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। কারণ তারা বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। ফলে ঘুরে ফিরে সেই বড় চাল ব্যবসায়ীরাই চাল আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করছে।
 
বুধবার (৩ মার্চ) নগরের পাহাড়তলী পাইকারী চালের বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে বিভিন্ন জাতের চালের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। চালের বাড়তি দামে ক্রেতাদের আনাগোনা নেই। বাড়তি দামের কারণে পাইকাররাও আমদানি কম করছেন। তাই বাজারে চালের সরবরাহও আগের তুলনায় কমে গেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখনও বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি দরে চাল বিক্রি করছেন। বর্তমানে ২০০ টাকা বাড়তি দরে জিরাশাইল চাল বস্তাপ্রতি ৩ হাজার ৪০ টাকা, পাইজাম সিদ্ধ ২২০ টাকা বাড়তি দরে ২ হাজার ৩৭০ টাকায়, মিনিকেট আতপ ২০০ টাকা বাড়তি দরে ৩ হাজার টাকায়, ৫০ টাকা বাড়তি দরে কাটারি আতপ ৩ হাজার ৪০০ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৩০০ টাকা বাড়তি দরে ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন পাইকাররা। তাছাড়া ২০০ টাকা বাড়তি দরে চিনি আতপ ৩ হাজার ৫০০ টাকায়, মোটা সিদ্ধ চাল ১০০ টাকা বাড়তি দরে ২ হাজার টাকায়, ২০০ টাকা বাড়তি দরে বেতী আতপ চাল ২ হাজার ৬০০ টাকায় এবং পাইজাম আতপ ২০০ টাকা বাড়তি দরে ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

অপরদিকে খুচরা বাজরে বিআর-২৮ কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৫২ টাকা, আপেল পাইজাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, সরু মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, আঠাশ মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৪ টাকা, নাজির শাইল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, কাটারি ৫৭ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। 
      
পাহাড়তলী বাজারে চাল কিনতে আসা স্কুল শিক্ষক সরওয়ার কামাল সিভয়েসকে বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা চেষ্টা করলেও সেদিকে কর্ণপাত করছেন না মিল মালিকরা। তিনমাস পার হয়ে গেল, অথচ পাইকারি আর খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েই চলেছে। আর পাঠার বলি হচ্ছি আমরা। আগে ৫০ কেজি চালের বস্তা কিনতাম। চালের দাম বেশি তাই এখন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করছি ২৫ কেজির বস্তা আছে কিনা।’

পাহাড়তলীর পাইকারি চালের দোকান মেসার্স ন্যাশনাল স্টোরের স্বত্তাধিকারী মোহাম্মদ ইউসুফ সিভয়েসকে বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হবার জন্য মিল মালিকরাই দায়ী। তারা আমদানি করছেন ঠিকই, কিন্তু বাজারে সরবরাহ করছেন কম। ফলে আমাদের চট্টগ্রামেও চালের সরবরাহ আগের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে। আমাদের কিছুই করার নাই। বাড়তি দামে চাল কিনে বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে সামনে বৈশাখ মাস আসছে। নতুন চাল আসবে। তখন চালের বাজার স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা বেশি।’ 

আরেক ব্যবসায়ী সিফাত স্টোরের মালিক এনাম তালুকদার সিভয়েসকে বলেন, ‘মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে আমরা চাল ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে গেছি। চালের দাম এখনো নিয়ন্ত্রণে আসে নি। আগে শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটির দিনে ক্রেতাদের ভীড় থাকতো দোকানে। আর এখন সকাল থেকে বসে আছি, তেমন বেচা-বিক্রি নেই। বরং ক্রেতারা এখন ৫০ কেজি চালের বস্তার বদলে ২৫ কেজি কিনতে চান।’     

সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, তাঁরা একটি গবেষণায় দেখেছেন, দেশে শত শত চালকলের মধ্যে প্রায় ৫০টি বাজারকে প্রভাবিত করে থাকে। তাদের মজুত করে রাখার ক্ষমতা অপরিসীম। এটা তারা বৈধভাবেই করতে পারে। 

পাহাড়তলি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন সিভয়েসকে জানান, চালের বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাবটা পড়েছে নর্থ বেঙ্গল থেকে। সেখানে এলসির মাধ্যমে চাল আমদানি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মজুদ করে রেখেছে। ফলে চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামটাও বেড়ে গেছে। এমনিতেই সারাবছর চট্টগ্রামের মানুষ আতপ চাল বেশি খায়। আসন্ন রোজায় আতপ চালের চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সরকার এরমধ্যে আতপ চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছেন। আশা করছি আসন্ন রমজানের আগেই চালের বাজার স্থিতিশীল হবে। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েসকে বলেন, ‘ভোজ্যতেলের মত উর্ধ্বমূখী চালের বাজারেও দাম বেঁধে দিয়ে, শুল্ক কমিয়ে, বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও কোন ভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। চিহ্নিত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহনে সক্ষম হন নি। এদিকে রমজানের আর বেশি দেরি নেই। এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এতে করে রমজানেও ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ জনগণ। তাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে এখন থেকে আমদানি, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে বিপনণে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।’

-সিভেয়স/টিএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়