Cvoice24.com

অস্তিত্ব সংকটে চট্টগ্রামে ৭৩ বছরে চামড়ার ব্যবসা

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২০ জুলাই ২০২১
অস্তিত্ব সংকটে চট্টগ্রামে ৭৩ বছরে চামড়ার ব্যবসা

রাত পোহালেই কাল পবিত্র ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হবে এ ধর্মীয় উৎসব। এবারের কোরবানির ঈদে সমগ্র চট্টগ্রামে প্রায় আট লাখেরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যাবে। চামড়া শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল চামড়ার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ঈদুল আজহার সময় সংগৃহীত হয়। তবে বিগত দুবছর ধরে চামড়া ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই। ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা না পেয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছেন অনেকেই। সবমিলিয়ে লোকসানের আশঙ্কা করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। 

নগরের প্রধান চামড়ার আড়তগুলো নগরের আতুরার ডিপো এলাকায়। কোরবানি ঈদের দিন নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া এনে সেখানে বিক্রির জন্য আসেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। আবার প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি চামড়া বিক্রি হয় নগরের চৌমুহনী এলাকায়।

নগরের আতুরার ডিপো এলাকার কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লকডাউনে সব ধরনের ব্যবসায় মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতেও চামড়ার বাজার অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তার প্রভাব
দেশেও পড়েছে। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে এনে আড়তে বিক্রি করেন। এসব মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অদক্ষতার কারণে অনেক চামড়া আড়তে আনতে আনতে পঁচে যায়। ফলে এসব চামড়া আর কেনা যায়না। এর একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে চামড়া খাতে।

এছাড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে ২৫ কোটিরও বেশি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলে যথোপযুক্ত মূল্য দিয়ে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে হিমশিম খেতে হয়। চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা ৭৩ বছরেরও বেশি পুরনো। কালের বিবর্তনে নানা সংকটে এ খাত তার জৌলুস হারিয়েছে। লোকসান গুণতে গুণতে একদিকে কমছে আড়তদারের সংখ্যা, অন্যদিকে ট্যানারির সংখ্যা এসে ঠেকেছে মাত্র একটিতে। 

বিগত দু’বছর ধরে চট্টগ্রামের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত দাম পান নি। তাই রাগে, অভিমানে সে চামড়ার ঠাঁই মেলে নগরের রাস্তা ও ফুটপাতে। বিগত দু’বছরে গড়ে ২২ হাজারের বেশি চামড়া নষ্ট হয়েছে। ফলে হাজার কোটি টাকা লোকসানও হয়েছে এ খাতে। 

আড়তদাররা দুটো বিষয় পরিস্কারভাবে তুলে ধরে সিভয়েসকে বলেন, 'চট্টগ্রামে মাত্র একটি ট্যানারি থাকায় ঢাকার ট্যানারিগুলোর উপর নির্ভর করতে হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বাকিতে চামড়া পাঠিয়ে দিতে হয়। এই বকেয়া টাকা পরিশোধ করতেও নানা ধরনের তালবাহানা শুরু করেন ট্যানারি মালিকরা। বিগত দু বছরের টাকা আদায় করতে পারলেও বিগত চার বছরের (২০১৫-২০১৮) প্রায় ২৫ কোটিরও বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।'

অন্যদিকে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কিছু অদক্ষতাজনিত ক্রটি রয়েছে। তারা না বুঝে অনেক সময় নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে বেশি দাম দিয়ে কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। পাশাপাশি লাভের আশায় সময়ক্ষেপণ করে এ চামড়া আড়তে আনতে আনতে পচে যায়। ফলে তা আর কেনার উপযোগিতা থাকে না। সেই সাথে চামড়া সংরক্ষণের প্রধান উপকরণ লবণের দামও বেড়েছে আকাশছোঁয়া। তাই সবমিলিয়ে চামড়া ব্যবসায়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চামড়া খাত তার অস্তিত্ব হারাতে বেশিদিন বাকি নেই বলে দাবি করেন আড়তদাররা।

জানা গেছে, ১৯৪৮ সাল থেকে বন্দর নগর চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসায়ের বিকাশ ঘটে। লাভজনক ব্যবসার মুখ দেখায় চট্টগ্রামে ১৬টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। কালের বিবর্তনে লোকসান গুণতে গুণতে প্রায় সব ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। বিগত পাঁচবছর আগেও চট্টগ্রামে সফলভাবে দুটি ট্যানারি চালু ছিল। এদের একটি মদিনা ট্যানারি ও অপরটি রিফ লেদার ট্যানারি। এ ট্যানারি দুটি ঢাকার ট্যানারিগুলোর সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা দিয়ে আসছিল। কিন্তু বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় পাঁচ বছর আগে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেয় মদিনা ট্যানারি। তবে সংকটকালীন সময়েও লড়াই করে টিকে আছে রিফ লেদার নামের একটি ট্যানারি। চট্টগ্রামে সমিতিভুক্ত আড়তদারের সংখ্যা ছিল ১১২ জন। এর বাইরে আরও অন্তত ১৫০ আড়তদার ছিল। তবে লোকসানে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেন ৭০ এরও বেশি আড়তদার। 

এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারো আড়তদারদের কাছ থেকে ট্যানারি মালিকরা কত টাকায় কোরবানি পশুর চামড়া কিনবেন তা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বছর প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়ার দাম হবে ৩৩ টাকা থেকে ৩৭ টাকা, লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই আড়তদাররাও  লবণ খরচ, শ্রমিক খরচ ও পরিবহণ খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ১৬ থেকে ২২ টাকায় কেনার অংক কষছেন। সে হিসাবে আড়তদাররা প্রতিটি গরু বা মহিষের চামড়া থেকে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় কেনার চিন্তাভাবনা করছেন।

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া ব্যবসায় খারাপ সময় যাচ্ছে। লবণের দাম, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা বকেয়া থাকায় এ খাত নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনের বিষয় তদারকির জন্য চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী পাঁচদিন এই কমিটি তদারকির কাজ করবেন।

জানা গেছে, পাঁচ সদস্যের এ কমিটি কোরবানের পশুর চামড়ার ক্রয়-বিক্রয় এবং কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুতের বিষয়টি তদারক করবেন। তাছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তা সমাধান করবেন। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করাও দায়িত্বের মধ্যে পড়বে বিভাগীয় কমিটির সদস্যদের।

চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের তদারকি কমিটিতে দলনেতা হিসেবে কাজ করবেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব লুৎফুন নাহার। এছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন— চট্টগ্রামের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিয়ন্ত্রক মো. আবদুর রহিম, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ, আরজেএসসির উপনিবন্ধক হারুন অর রশীদ, টিসিবি আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী জামাল উদ্দিন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়