Cvoice24.com

সংকটে চট্টগ্রামের চামড়া খাত, ব্যবসা গুটিয়ে নিল ৬৭ আড়তদার

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৮:৪৩, ২৩ জুন ২০২২
সংকটে চট্টগ্রামের চামড়া খাত, ব্যবসা গুটিয়ে নিল ৬৭ আড়তদার

দেশের চামড়া শিল্পে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। প্রতি বছর শুধুমাত্র কোরবানি ঈদে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ পশুর চামড়ার যোগান দেয় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার টানা দরপতনে ব্যবসায় লোকসান ও ইটিপি (ট্যানারি) স্থাপন করতে না পারায় আসন্ন কোরবানি ঈদ নিয়ে শঙ্কায় সময় পার করছেন নগরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। তার উপর লবণের দাম বৃদ্ধি, কোরবানে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অদক্ষতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসসহ মোট আট কারণে চট্টগ্রামে চামড়া খাতের এ সংকট কাটছেই না। পাশাপাশি লোকসানে জর্জরিত হয়ে চট্টগ্রামের অন্তত ৬৭ আড়তদার ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

মূলত চট্টগ্রাম থেকে দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচামালের বড় যোগান আসে। তবে বছর ঘুরলেও চামড়া ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। পবিত্র ঈদুল আজহায় কমপ্লায়েন্সের অভাব, ঋণের অভাব, ট্যানারির অভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস, রাসায়নিক দ্রব্য ও লবণের বাড়তি দাম, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে ধীরগতি, প্রণোদনা ঘাটতি, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দক্ষতার অভাবে চামড়া খাতে সংকট কাটছে না বলে জানান ব্যবসায়ীরা।  

নগরের আতুরার ডিপো এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটা সময় কোরবানের ঈদ এলে ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি চামড়া সংগ্রহেও একটা বড় ধরনের উৎসব তৈরি হতো। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে তাদের মাঝে সে আমেজ আর নেই। চট্টগ্রামের চামড়া খাত বর্তমানে একটা মাত্র ট্যানারি (রিফলেদা)’র উপর নির্ভর করে আছে। তার উপর পশু জবাইয়ের আট থেকে দশ ঘন্টার মধ্যে লবণ লাগানোর কথা থাকলেও গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আনতে আনতে অধিকাংশ চামড়ার গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। চামড়া কেনা বা প্রাথমিক সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-নীতি মানতে হয়। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে কোরবানের দিন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ছাত্ররা এ ব্যবসায় জড়িয়ে যায়। চামড়া সংরক্ষণের ন্যূনতম জ্ঞানই তাদের মধ্যে নেই। তাদের কারণে চামড়া খাতে একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। দিন দিন যেকোন খাতে উদ্যোক্তা বাড়ে। অথচ চামড়া খাতে তার উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হওয়ায় বর্তমানে চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী চামড়ার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন।

চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সিভয়েসকে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। এর পাশাপাশি কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণেই চট্টগ্রামের চামড়া খাত আজ সংকটের মধ্যে পড়েছে। চামড়া সংরক্ষণের প্রধান উপাদান লবণ। অথচ এই লবণ প্রতিবস্তায়  ৪’শ থেকে ৪৫০ টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ গতবছর ৬’শ থেকে ৬৫০ টাকায় কেনা লবণ এ বছর এক হাজার থেকে ১১’শ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে বা সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে ঋণের প্রয়োজন হয়। সরকার বিভিন্ন সুবিধায় ট্যানারি মালিকদের ঋণ দিলেও আমাদের জন্য ওরকম ব্যবস্থা নাই। তবে ব্যক্তিগতভাবে চাইলে কেউ নিতে পারে। সেখানে আবার সুদসহ অনেক টাকা গুণতে হয়।

তিনি বলেন, সরকার চামড়া কেনার জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তা লবণযুক্ত। যত বড় চামড়া হোক চট্টগ্রামের চামড়াগুলো ২০ থেকে ২২ ফুটের বেশি ধরা হয় না। ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত চামড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাদ দিয়ে কেনে। লবণ, কর্মচারি সবমিলিয়ে প্রতি চামড়ায় আমাদের ২’শ টাকা খরচ পড়ে। সরকার ফুটপ্রতি পুরো চামড়ার রেট দিলেও ট্যানারিমালিকরা যেহেতু কিছু অংশ বাদ দিয়ে কেনেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পুরো চামড়ার রেট চান। কিন্তু আমরাও তো ট্যানারির হাতে ধরা। এটা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বোঝেন না। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলব, গ্রাম থেকে চামড়া আনতে দেরি হলে লবণ দিয়ে দিতে হবে। এতে করে এই জাতীয় সম্পদটা নষ্ট হবে না। 

ব্যবসা গুটিয়েছেন চট্টগ্রামের অন্তত ৬৭ চামড়া ব্যবসায়ী

ঋণ ও লোকসানে জর্জরিত হয়ে চট্টগ্রামের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সদস্যভুক্ত ১১২টি আড়ত ছিল। তবে বর্তমানে ৪৫ জন চামড়া ব্যবসায়ী ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাকিরা অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে গেছেন। 

এদিকে ১৯৯০ সালের দিকে চট্টগ্রামের মাটিতে গড়ে উঠেছিল ২২ ট্যানারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত কয়েক বছরের চামড়ার টানা দরপতনে ব্যবসায় লোকসান ও ইটিপি স্থাপন করতে না পারায় ২১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেটি শতভাগ ইটিপি চালু করে চামড়ার ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে কম দামে ও বাকিতে চামড়া বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা।

কমেছে চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা

পাঁচ বছর আগেও পবিত্র ঈদুল আজহার সময় চট্টগ্রামে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তিন লাখের ঘরে। গতবছর কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে তিন লাখ। তার বিপরীতে সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র দুই লাখ। ২০২০ সালে ৪ লাখ ও তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সাড়ে ৩ লাখ কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। চলতি বছরও তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। নানা সমস্যার কারণে দিন দিন চট্টগ্রামে চামড়া সংগ্রহের হার কমছেই।

কমেছে রপ্তানি

চট্টগ্রাম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, কানাডা, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, রাশিয়া, পোল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়। তবে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইতালীতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দেশটিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে চামড়া খাতে রপ্তানিও কমে গেছে। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার চামড়া-চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ফলে রপ্তানিতেও কিছুটা ভাটা পড়েছে। 

বিনিয়োগে ভাটা

লোকসান ও বিভিন্ন সমস্যা থাকায় চামড়া খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। এ কারণে এ খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। সবমিলিয়ে চামড়া খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। 

বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ মাসে বিডার অন্তর্ভূক্ত দুটি প্রতিষ্ঠান চামড়া ও পাদুকা খাতে ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১৬০ জন লোক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। 
 
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। আমরা সব সময় মৌসুমী ব্যবসায়ীদেরকে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে চামড়া কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এরপরও তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেন। লবণের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা আমাদের কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে আমরাও নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত দাম দেয়ার চেষ্টা প্রতিবছরই আমাদের থাকে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম সিভয়েসকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা হলো চামড়া খাত। অথচ চট্টগ্রামে এ খাতে একটা নাজুক অবস্থা আমরা লক্ষ্য করছি। চট্টগ্রামে দুটা ট্যানারি চালু ছিল। এরমধ্যে টিকে গ্রুপের ট্যানারিটা চালু আছে। মদিনা ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ২২টার বেশি ট্যানারি ছিল চট্টগ্রামে। এটা কিন্তু চামড়া খাতের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। তাই চামড়া খাতে পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে কমপ্লায়েন্সের দুরাবস্থা দূর করতে হবে। বিশেষ করে ঈদুল আজহায় স্বাস্থ্যকর ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে চামড়া সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি চামড়াখাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানে কাজ করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, চামড়া খাতের অবস্থান আরো আগে থেকেই খারাপ ছিল। পাশাপাশি চামড়া খাতকে প্রসারিত করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন সেটা আমরা নিতে পারছি না। চামড়া খাতকে এগিয়ে নিতে হলে রপ্তানি অথবা দেশিয় ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়