গৌরব ও ঐতিহ্যের ৫৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৮ নভেম্বর ২০২১
গৌরব ও ঐতিহ্যের ৫৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) গৌরব ও সাফল্যের ৫৬ বছরে পা দিলো।১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

৫৫ বছর আগে চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে চারটি বিভাগ, ২০৪ জন শিক্ষার্থী ও সাত শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৬ সালে ১৮ নভেম্বর উদ্বোধনের পর ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু হয় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। অর্ধ শতাব্দী পরে বর্তমানে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। পাঠদানে রয়েছেন ৯০৬ জন শিক্ষক। ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ছাড়াও রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল ও ১টি ছাত্রবাস রয়েছে। এর মধ্যে ছেলেদের জন্যে ৯টি ও মেয়েদের হল রয়েছে ৫টি। আবাসিক হল ও হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৭ হাজার আসন বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিভিন্ন বাসা ও কটেজে থাকছে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী। বাকি ১৫ হাজার শিক্ষার্থী থাকছে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন বাসা ও মেসে। নগরের এসকল শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রয়েছে শাটল ও ডেমু ট্রেন।

গুণীজন

বাংলাদেশ থেকে একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদ একুশে পদক প্রাপ্ত প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। যিনি শুধুমাত্র দেশের টানে বিদেশের চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদ আবদুল করিম, একুশে পদকজয়ী সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, শিক্ষাবিদ আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরী, কলামিস্ট আবুল মোমেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন । সাবেক জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অপরাজেয় বাংলার স্থপতি ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদ, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন সহ দেশ বরেণ্য বহু কীর্তিমান মনীষীর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাফল্য

শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির যথেষ্ট সুনাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো শাহাদাত হোসেন মাছের দুটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার ও শনাক্ত করেছেন। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী রক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য  শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া পেয়েছেন দেশী-বিদেশী নানা সম্মাননা। ড. শেখ আফতাব উদ্দিন কম খরচে সমুদ্র পানি সুপেয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। ড. আল আমিনের লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রের ৬ টি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বুক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী বঙ্গোপসাগরের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করে খ্যাতিলাভ করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক স্ব স্ব ক্ষেত্রে রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। পিছিয়ে নেই শিক্ষার্থীরাও। ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ছাত্র সাজিদ আলী হাওলাদার। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটিার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন ও তার দলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গর্ভনর ফজলে কবির, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১১জন সচিব ও ৩০ জন অতিরিক্ত সচিব পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চবির সাবেক শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার সাথে।

সংগীতাঙ্গনে চবি

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষার্থীরা। দেশের সংগীতাঙ্গনের পুরোধাদের অধিকাংশই চবির শিক্ষার্থী। সোলসের পার্থ বডুয়া, রেঁনেসা ব্যান্ডের নকীব খানসহ বাপ্পা মজুমদার, এস আই টুটুল এবং নাট্যকার হাসান মাসুদ, নাট্যকার সোহেল খান, নাট্য অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তি কর, চিত্রলেখা গুহ সবাই চবির শিক্ষার্থী ছিলেন।

ইতিহাসে চবি

কেবল গবেষণা আর পড়ালেখায় নয় দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে এ বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। ৬৯’র গণঅভুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যার সাক্ষী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ১৫ জন মহানায়ক তাদের নিজের জীবন বিলিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন পেয়েছেন বীর প্রতীক খেতাব।

স্থাপত্যকর্ম

সবুজ ঘেরা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নজরকাড়া সব স্থাপত্যকর্ম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রয়েছে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর সন্তানদের স্মৃতিকে অমলিন করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখেই নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত “বঙ্গবন্ধু চত্বর”। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’।

এছাড়া ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠত জাদুঘরে রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ বিখ্যাত সব শিল্পীদের শিল্পকর্ম, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর নানা কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তিসহ প্রাচীন জীবাশ্মের সংগ্রহ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে রয়েছে ‘প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর', উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হার্বেরিয়াম ও সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে রয়েছে সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় লিখিত সুপ্রাচীন সব পান্ডুলিপির সংগ্রহ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে গড়ে তোলা হয়েছে ডিজিটাল মিডিয়া ল্যাব টেলিভিশন স্টুডিও। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধীনে জলবাুয় পরিবর্তন বিষয়ে গবেষণার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে উন্নত সুবিধাসমতি গ্রিন হাউস প্রকল্প। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে রচিত বইয়ের সংগ্রহে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’।

চবিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যারা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বারোজন শিক্ষার্থী ও তিন জন কর্মকর্তাসহ মোট ১৬ জন শহীদ হন। শহীদরা হলেন: প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীর প্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবদুর রব, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, বাংলা বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম খোকা, মোহাম্মদ হোসেন, মোস্তফা কামাল, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান, আবদুল মান্নান, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ উদ-দৌলা, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারি, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন এবং আলাওল হলের প্রহরী ছৈয়দ আহমদ। 

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়। তিনি গণবাহিনী (সেক্টর-১)-এর অধিনে নৌ-কমান্ডো হিসাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন।

আরও পড়ুন ...

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়