‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার সাথে কতটুকু মিল চবির

আলমগীর মোহাম্মদ

প্রকাশিত: ১৪:১৫, ১৮ নভেম্বর ২০২১
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার সাথে কতটুকু মিল চবির

আলমগীর মোহাম্মদ, সাবেক শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগ (ব্যাচ-৪৫)-চবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান। বাঁশখালী থেকে এসে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো ভাবিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা। কলেজে ছাত্র শিক্ষক পরিচয় পর্বে শিক্ষকরা তাঁদের সাবেক আলমা ম্যাটারের কথা বলায় মনে মনে স্বপ্ন বুনতে থাকি আমিও একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। গ্রাম থেকে এলেও সরকারি কলেজের পরিবেশ ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। আমাদের শিক্ষকরা আন্তরিক ছিলেন। দর্শনের বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন কবির একদিন আমাকে বললেন, ‘এই ছেলে, তুমি ফিলোসোফি নিয়ে ভার্সিটিতে পড়বে।’ 

যুক্তিবিদ্যা আমি ভালো বুঝতাম। সাথে তো মুখস্থ বিদ্যার জোর ছিলই। স্যারের সেদিনের উৎসাহ মনে আরো সাহস জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে আমার শিক্ষক প্রফেসর আবদুল কাইয়ুম নিজামী আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। অবশ্যই পরে চবিতে কলা ফ্যাকাল্টিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই।

একটা বিষয় আমার শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করি প্রায় সময়। সেটা হলো— চট্টগ্রাম বিস্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বার গিয়েছিলাম ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। জারুল তলার বুদ্ধিজীবী চত্বরে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে খাদির শাল একদল প্রফেসর দেখলাম বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জড়ো হয়েছেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সেই দৃশ্য। ভর্তি শেষে আমাদের প্রথম ক্লাস হয় ১২০ নম্বর কক্ষে। যেটাকে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস বলা হয়। আমাদের স্যাররা কথা বললেন একে একে। নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষে আমি কথা বলেছিলাম। সেদিন সাহস সঞ্চয় করে কী কী বলেছিলাম মনে না থাকলেও এতটুকু মনে আছে যে, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে পারার খুশি প্রকাশ করেছিলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আমার কাছে প্লেটোর কথিত রূপক গুহের মতো। কেন ভর্তি হয়েছিলাম, বিভাগের সিলেবাসে কি আছে, ইংরেজি বিভাগের ভিশন-মিশন কী কোন কিছুই না জেনে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। ইংরেজি বিভাগের সিলেবাস আমাদের অনেকের চোখ খুলে দিয়েছিল। বিভাগ নিয়ে নানারকম নেতিবাচক প্রচলিত মিথ শুনে যখন হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই প্রথম বর্ষ ফাইনালের রুটিন পেয়ে যাই আমরা।  দীর্ঘদিনের সেশনজট, লো সিজিপিএ, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া এসব হতাশাব্যাঞ্জক কথা শুনে যখন হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাবিতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তখন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। স্যারের সাথে দেখা করে রুটিনের কথা শুনে আর বিভাগ পরিবর্তনের কথা ভাবিনি। পরে নানা রকম সরল, গরল, আনন্দ, তিক্ততার মধ্য দিয়ে পাঁচ বছরের কোর্স সাত বছর দশ মাসে পাস করে বের হই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চারটি বিভাগের একটি হলো ইংরেজি বিভাগ। প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশের খ্যাতনামা ও মেধাবী সব শিক্ষক দিয়ে যাত্রা করা এই বিভাগে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কোন এক অজ্ঞাত কারণে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ হয় না বিভাগে। শিক্ষকদের আন্তরিকতা থাকলেও জনবল ঘাটতির কারণে ঠিক সময়ে ক্লাস পরীক্ষা নেওয়া হয় না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সেশনজট কমছেই না। চার বছরের কোর্স করতে ছয় বছর লেগে যাচ্ছে যা একজন শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতি। সাথে বিশ্ববিদ্যালয়েরও অর্থ অপচয় হচ্ছে। 

সেশনজটের সাথে আছে লো-সিজিপিএর অভিশাপ যার কারণে বিভাগ থেকে গত দশ বারো বছরে পাস করা কোন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছে না। এমনকি মেধা তালিকায় প্রথম-দ্বিতীয় স্থান লাভ করা শিক্ষার্থীরাও একই অভিশাপের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এই বিভাগের গ্র্যাজুয়েটরা। কোথাও আবেদনের সুযোগ পেলেও প্রথম যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সেটা হলো আপনার সিজিপিএ এত কম কেন? 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স পঞ্চান্ন পেরুলো এবার। কিন্তু এত বছরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কি সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পেরেছে? কার্ডিনাল নিউম্যানের দ্য আইডিয়া অব ইউনিভার্সিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা আমরা পাই তার সাথে কতটুকু মিল আছে আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের সাথে? ইংরেজি ও বাংলা পাশাপাশি দুটো বিভাগ। সাহিত্যের এই দুইটি বিভাগ বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের সাহিত্যে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছে সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। গবেষণার কথা বলবেন?  সে আলাপ তো না করাই ভালো। 

গত পঞ্চান্ন বছরে কয়জন গবেষক তৈরি করতে পেরেছে ইংরেজি বিভাগ? অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো কলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে গবেষণাকে খুব পরিষ্কার ভাষায় নিরুৎসাহিত করা হয়। মাস্টার্সে থিসিস করানো হয় না। পিএইচডি এমফিলে ভর্তির ন্যুনতম যোগ্যতা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যেখানে কোন কোন বিভাগের ফার্স্ট সেকেন্ড পজিশনধারীরাও আবেদন করতে পারেন না। নানা সময়ে এই ব্যাপারে আগ্রহীরা শিক্ষকদের দ্বারস্থ হলেও অজ্ঞাত কারণে সে বিষয়ের কোন সুরাহা হয় না। উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি দিতে এই অনীহার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আগ্রহ থাকার পরও গবেষণা কর্মের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই জায়গায় চবি কি পুরোপুরি ব্যর্থ নয়? 

আট বছরের শিক্ষাজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কখনো শিক্ষার্থী বান্ধব মনে হয়নি আমার। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেট সরবরাহ ত্বরান্বিত করা, উন্নত মানের ল্যাব সুবিধা (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাংগুয়েজ ল্যাব নেই) নিশ্চিত করা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারের নিয়মনীতি শিথিল করা, শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি ও মানোন্নয়ন করা, শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রুটে মানসম্মত পরিবহনের ব্যবস্থা করা, ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা করা, চাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন মতো আবাসন নিশ্চিত করা প্রভৃতি কাজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিকভাবে করছেন না। সুদূর চট্টগ্রাম শহর থেকে যাওয়া আসা করার ব্যস্ততায় দিনের অনেকটা সময় অপচয় হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। আবাসন সংকট সমাধান করা গেলে, যাতায়াতের মাধ্যমগুলো মানসম্মত করতে পারলে এই অপচয় অনেকটা রোধ করা সম্ভব।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কী চট্টগ্রাম তথা দেশবাসীর মেধা মনন বিকাশে সার্থক ভূমিকা পালন করছে?— এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হবে। দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বড় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌথ প্রচেষ্টায় পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক চর্চা, গবেষণায় আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারতো যদি সংশ্লিষ্ট সবাই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সহিত তাঁদের দায়িত্ব পালন করতেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো বর্তমানে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কোন মেধাবী মুখকে প্রাণ দিতে হচ্ছে না আর। বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা হচ্ছে। সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসছেন চবি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমার জন্য সুখের। পঞ্চান্নতম বর্ষপূর্তিতে আমরা আশা করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ থেকে নিয়মিত গবেষণা জার্নাল বের হবে ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ উদ্যোগে, একটা অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবে, চবি প্রেস থেকে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের লেখা বই, গবেষণা প্রকাশিত হবে এতটুকু আশা করা যায়। অতি শীঘ্রই সেশনজট নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রসমাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরে আমি গর্বিত। 

 

লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী (ব্যাচ-৪৫), বর্তমানে বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লায় কর্মরত।

 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়