Cvoice24.com

সিউলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:২৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
সিউলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের পুষ্পস্তবক অর্পণ

সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে মাহন শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পূর্ণ মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য দূতাবাস তিন পর্বের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে।

রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান সিটিতে অবস্থিত শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহীদ মিনারে স্থানীয় সময় রবিবার সকালে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক দূরত্ব কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে প্রভাতফেরি ও পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

সকালে দূতাবাস প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রদূত কর্তৃক জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করবার মধ্য দিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু হয়। সামাজিক দূরত্ব কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কারণে শুধুমাত্র দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এরপর দূতাবাস প্রাঙ্গণে অধিষ্ঠিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। 

অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ, ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নিরবতা পালন, মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কর্তৃক প্রদত্ত বাণীসমূহ পাঠ। 

উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে দিবসটির তাৎপর্যের ওপর আলোকপাত করা হয়। আলোচকগণ তাদের আলোচনায় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভে ভাষা শহীদদের চূড়ান্ত আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং মাতৃভাষার মর্যাদা ও সম্মানকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দূতাবাস কর্তৃক গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়াস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিকবৃন্দ, দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো (কেএনসিইউ)-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক, কেএনসিইউ-এর মহাসচিব, পূর্ব তিমুর, পাপুয়া নিউ গিনি, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতগণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক এবং গিওরমাল-কেওনসাজিওন’র মহাসচিবসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকবৃন্দ অংশহগ্রহণ করেন।

উক্ত অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি পরিবেশন করা হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর শুভেচ্ছা বক্তব্য ও বহুভাষাবাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের উন্নয়নের ওপর দেশভিত্তিক গৃহীত কার্যক্রমের ওপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে দূতাবাস কর্তৃক মহান শহীদ দিবস ও কোরিয়ার হাঙ্গুল (Hanguel) দিবসের সামঞ্জস্যের ওপর নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলা ভাষা প্রসারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দূতাবাস কর্তৃক সম্মাননা প্রদানকৃত দুইজন বাংলাদেশি নাগরিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।

রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তার বক্তব্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা রক্ষায় যে সকল ভাষা শহীদেরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, ‘তার (বঙ্গবন্ধু) ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধিকারের বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।’

মুজিববর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপনের বিষয়টি উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ৫০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আলোকপাত করেন। 

তিনি বলেন, ‘২১ বছর আগে ইউনেস্কো কর্তৃক মহান শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে একুশের চেতনা বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা ভাষাগত বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতে সক্ষম  হয়েছি।’ 

এ বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুভাষাবাদকে উৎসাহিত করা’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম টেকসই উন্নয়ন এবং সকলের সমান অংশিদারিত্ব নিশ্চিতকরণে বহুভাষাবাদ বিকাশ ও প্রচারের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
  
ইউনেস্কো সম্পর্কিত কোরিয়ান জাতীয় কমিশনের মহাসচিব হান কিউং কো তার বক্তব্যে দুই কোরিয়ার নৃতাত্ত্বিক ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি দুই কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কোরিয়ান ভাষার ওপর একটি অভিন্ন অভিধান সংকলনের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।

ঔপনিবেশিকতা হতে মুক্তি ও মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামকে দুই দেশের ইতিহাসে এক অভিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্যুরোর মহাপরিচালক কিম জুং হান মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘উভয় দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, জাতির পরিচয় বহনে, সক্ষমতা এবং স্বাধীনতা অর্জনে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।’ 

তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল্যবোধগুলো যেমন বহুভাষাবাদ সংরক্ষণে ও এর বিকাশে বহুপাক্ষিকতা, সহ-অস্তিত্ব এবং সংহতির ওপর জোর দেন।
 
পূর্ব তিমুর, পাপুয়া নিউ গিনি, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা দেশসমুহের রাষ্ট্রদূতগণ তাদের বক্তব্যে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং এ ঐতিহাসিক দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর প্রশংসা করেন। এছাড়া তারা বহুভাষাবাদের উন্নয়নে তাদের দেশ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর বিস্তারিত বক্তব্য প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক এবং গিওরমাল-কেওনসাজিওন’র মহাসচিব বহুভাষাবাদের উন্নয়নে তাদের সকারের বিভিন্ন উদ্যোগগুলি তুলে ধরেন।
 
পূর্ব তিমুরের সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত আদলগিসা মারিয়া সোয়ারস জেমিনেস তার দেশ বহুভাষাবাদ সংরক্ষণে ও বিকাশে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, ‘পূর্ব তিমুর মূলত দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক দেশ যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ। সেখানে সরকারি ভাষা-পর্তুগিজ ও তেতুম ছাড়াও ১৬ টি ভিন্ন ভাষা রয়েছে।’

ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন বিশ্বকে মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগগুলির প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতে ২১টি প্রধান ভাষা রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাষাভাষী, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মানুষেরা তাদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলে থাকে।’

নেলসন ম্যান্ডেলার কন্যা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত জেনানি এন ডামিনি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, তার দেশেও ভাষার জন্য মানুষ জীবন উৎসর্গ করে। তাদের স্মরণে ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘যুব দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। তারপরে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারী ভাষা হিসাবে বিভিন্ন মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। 

তিনি আরও জানান, বর্ণবাদ প্রথা চলাকালীন সময়ে মাত্র দুটি ভাষা- ইংরেজি এবং আফ্রিকান সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিলো। তার পিতা নেলসন ম্যান্ডেলা কর্তৃক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন ১১টি ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং ১১টি সরকারী ভাষার মধ্যে ৫টি ভাষায় বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়ে থাকে।

পাপুয়া নিউ গিনির রাষ্ট্রদূত অ্যান্ড্রু ইয়ামানিয়া তার দেশকে সংস্কৃতি ও ভাষার বিচারে পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সেখানে ৮০০ টিরও বেশি নৃতাত্ত্বিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে যা সারা বিশ্বের ব্যবহৃত ভাষার এক-তৃতীয়াংশ। দুঃখজনকভাবে,  অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অভিবাসনের কারণে পাপুয়া নিউ গিনির বেশ কয়েকটি স্থানীয় ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছে বলে জানান তিনি। দেশের বিভিন্ন ভাষাগুলি সংরক্ষণের জন্য তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ’র মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। সেই সাথে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশসহ মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা চালুর কথা উল্লেখ করেন।

গিওরমাল-কেওনসাজিওন’র মহাসচিব মিস মো সুন-ইয়াং তার বক্তব্যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কোরিয়ান ভাষা সংক্রান্ত একটি অভিন্ন সংবিধান সংকলনের চলমান প্রকল্প সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে উভয়পক্ষ এ সংক্রান্ত মোট ২৫টি যৌথ সভা করে ৩০ হাজারেরও বেশি শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে।

পরিশেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে বাংলাদেশ, ভারত ও কোরিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের ধারণকৃত পরিবেশনা প্রদর্শন করা হয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়