৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ
আইয়ুব বাচ্চুর নামে একাডেমি করা হোক
লিখেছেন : রশীদ এনাম
'সুখেরই পৃথিবী সুখেরই অভিনয় যত আড়ালে রাখো আসলে কেউ সুখী নয় নিজ ভুবনে চিরদুঃখী আসলে কেউ সুখী নয়'
আইয়ুব বাচ্চুর সুরে গানটি শুনলে মন কেঁদে ওঠে। গীটার জাদুকর শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু নেই বিশ্বাস হয় না।
শিল্পী মোহাম্মদ আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের এনায়েত বাজারস্থ ৩৪৪ জুবিলী রোডে, এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম ছিল রবিন। আইয়ুব বাচ্চু নামে সবাই এক নামে জানেন। অনেকে এবি বলে ডাকেন। দাদাবাড়ি পটিয়ার খরনা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। হাজি নুরুজ্জামান আবাসিক এলাকার ফিরিঙ্গি বাজারে সখিনা ভবনে তাঁর শৈশব কেটেছে।
বাবা-মা চাইতেন না যে ছেলে গানবাজনা করুক গায়ক হোক। বাচ্চুর বাবা বলতেন বাড়িতে বাউলদের কোনো জায়গা নেই। কোনো এক সময় অভিমান করে বড়ো স্বপ্ন নিয়ে চলে আসেন কংক্রিটের নগরী ঢাকায়, মাত্র ৬০০ টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন, এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে ওঠেন। হোটেলের লবিতে পাটি বিছিয়ে মেঝেতে থাকতেন। স্বপ্নবাজ বাচ্চু একসময় অনুশীলন, সাধনা, একাগ্রতায়, ইচ্ছায় দেশবরেণ্য গিটার জাদুকর ও গায়ক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।
এবি গান গেয়ে প্রথম সম্মানি পেয়েছিলেন ৩০ টাকা। ছোটবেলা থেকে গিটার বাজাতে পছন্দ করতেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত থেকে হাতে গিটার নিয়ে বন্ধুদের সাথে গাইতেন বাজাতেন। স্পাইডার ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকব ডায়েসের হাতে তাঁর গিটারের হাতেখড়ি। এক সময় বন্ধুরা মিলে গোল্ডেন বয়েজ পরবর্তীতে আগলী বয়েজ নামে ব্যান্ড গঠন করেন। পরবর্তীতে স্পাইডার ব্যান্ডে গিটার বাজাতেন। ১৯৭৮ সালের ফিলিংস ব্যান্ডের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু। এবির কণ্ঠে ১ম গাওয়া গান ছিল শহীদ মাহমুদ জঙ্গী মামার লেখা ’হারানো বিকেলের গল্প’। ১৯৮০ সালের দিকে যোগ দেন সোলসে। সোলসে ছিল, সাজেদুল আলম, তপন চৌধুরী, নকিব খান, রনি বড়ুয়া, পিলু খান, শাহেদ, লুলু।
১৯৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবাম ছিল ‘রক্ত গোলাপ’। ১৯৮৮ সালে ময়না, ১৯৯৫ সালে কষ্ট, ১৯৯৮ সালে সময়, ১৯৯৯ সালে একা, ২০০২ সালে প্রেম তুমি কী, দুটি মন কাফেলা নামে একসাথে তিনটি একক অ্যালবাম বের হয়। ২০০৩ সালে প্রেম প্রেমের মতো, ২০০৪ সালে পথের গান, ২০০৬ সালে ভাটির টানে মাটির গানে, ২০০৬ সালে জীবন, ২০০৭ সালে সাইন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল), ২০০৮ সালে রিমঝিম বৃষ্টি, ২০০৯ সালে বলিনি কখনো, জীবনের গল্প ২০১৫ সালে। ১৯৯০ সালের দিকে এলআরবি ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করলেন, এলআরবির পুরো নাম ছিল-লাভ রানস ব্লাইন্ড পরে হলো লিটল রিভার ব্যান্ড।
এবি ব্যক্তিগত জীবনে বেশ সদালাপী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ছিল আধুনিক। বিনয়ী আইয়ুব বাচ্চু সদা হাস্যোজ্জ¦ল, প্রাণবন্ত উপস্থাপনা ও গান গেয়ে গিটার বাজিয়ে মুগ্ধ করেন দর্শক শ্রোতাদের। মানুষের সাথে প্রথমে সালাম দিয়ে পরিচিত হতে পছন্দ করতেন শুধু তাই নয় মানুষদের খুব ভালোবাসতেন। বাচ্চু ভাই আমার নিজের এলাকার হওয়াতে প্রথম আলোর মাদবিরোধী কনসার্ট, জিপি-৫ সংবর্ধনা এবং চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকার মেজবানে ভাইয়ের সাথে দেখা হলে কথা হতো। দুষ্টামি করে বলতেন, আরাঁ ওবা পটিয়ার গম ফোয়া। চাটগাইয়া ফোয়া মানে মেডিত ফরিলে লোহা। ২০১৬ সালে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রিড় কমপ্লেক্সের মাটে চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকার মেজবানে ছোট ছোট শিশুদের স্টেজে নিয়ে গিটার বাজিয়ে নেচে-গেয়ে মাতিয়েছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চু শিশুপ্রেমীও ছিলেন কনসার্টে শিশু দেখলে স্টেজে ডেকে নিতেন নাচার জন্য। খুব কাছের এক আত্মীয়ের এক শিশুর চিকিৎসার জন্য তিনি ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছিলেন। তাঁর ভালোবাসায় সেদিন সেই শিশুটি বেঁচে যায়। বিশেষ করে তাঁর মাকে খুব বেশি পছন্দ করতেন। গত ২০০৪ সালের দিকে বাচ্চুর মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন মায়ের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন। বিদেশে নিয়েও চিকিৎসা করিয়েছেন। এবি সবসময় বলতেন, ‘দেশকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে কেননা মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে’। বাচ্চু ভাইয়ের একটা সাক্ষাত দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে কেঁদেছিলাম। বাচ্চু ভাই বলেছিলেন “বাবা মা ছাড়া তো আমি কিছুই না। বাবা-মায়ের অবদান আমার জীবন। সবার বাবা মা আছেন। কারও বা নেই ওপারে চলে গেছেন। মা-বাবা ছাড়া সন্তান পৃথিবীতে আসেন না, এটা একটা আল্লাহ নেয়ামত। যারা বাবা-মাকে বৃদ্ধআশ্রমে পাঠায়, একটা মানুষের জন্য এর চেয়ে বড়ো লজ্জাকর আর কিছু হতে পারে না। বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নিজে দামী গাড়িতে ছড়ে, দামী বাড়িতে থেকে, দামি খাবার খেয়ে কি লাভ ? যে মায়ের গর্ভে ১০ মাস ১০ দিন জন্মেছি আমি সে মাকে বৃদ্ধশ্রমে রেখে আসছি, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য সন্তানের জন্য কি হতে পারে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। টাকা পয়সা থাকলে বৃদ্ধআশ্রমে না পাঠিয়ে অন্তত একটা ঘর ভাড়া করে মাকে আলাদা রাখুন। তবু মাকে আলাদা স্বাধীনতা দেন। বৃদ্ধাশ্রম বাবা মায়ের জীবন হতে পারে না। প্লিজ কেউ যেন তাঁদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠায়”।
গীটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলো তাঁর ছিলো শিকড়ের প্রতি প্রচন্ড টান। পটিয়া ইশকুল মাঠে কনসার্টে এসে বলেছিলেন “আঁর বাড়ি পইট্যা তোয়ারা আঁরে গাইবের লাই নহ ডাহ দওত ন দ”- আমার বাড়ি পটিয়া তোমরা আমাকে গাওয়ার জন্য দাওয়াত করো না। ” তখন একজন বললেন ভাই, আপনার সম্মানি বেশি সে জন্য সাহস করিনা। আগে দওত দিতা সম্মানি ন লইতাম এরি- আগে দাওয়াত করে দেখতে সম্মানি না নিতাম” বাড়ির মানুষ থেকে টাকা কেন নিব ? হা হাহা বলে হাসতে থাকে।
১৯৯৮ সালের কথা একবার আমেরিকা নিউয়র্কে কনসার্ট করতে গিয়েছিলেন। কনসার্ট শেষে এলআরবি ব্যান্ডের সদস্যদেও নিয়ে গিটারের একটা শপিংমলে ঢুকেন। বড়ো একটা গিটারের দোকানে গিয়ে গিটারগুলো দেখেন। আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের প্রতি ধারুন আসক্তি নতুন ব্রান্ডের গিটার দেখলে হাতে নিয়ে চাইতেন আইভানেজ গিটারের ওপর চোখ পড়াতে সেটি তাঁর পছন্দ হয়। গিটারটি দেখতে চাইলে দোকানদার জিজ্ঞেস করে কোন দেশ থেকে এসেছে ? দোকানদার খুব তা”্ছল্যিা করে বললো এই গিটার বাংলাদেশির জন্য নয়। এই দেশে এটা সবচেয় দামি গিটার তুমি কিনতে পারবে না অন্যটা দেখ। দোকানদারের কথা শুনে বাচ্চু খুব আহত হন। সবচেয়ে বেশি কষ্টপান দেশকে অপমান করাতে। বাচ্চুর মনে মনে ভাবল যে করে হোক গিটারটি দেখতে হবে। জেদ চেপে বসে অনেকটা। দোকানদারকে বললো আমার দলের সবার কাছে যে টাকা আছে প্রত্যাশা গিটারটি নিতে পারব। দোকানদারের ইচ্ছা না থাকা সত্তে¦ও গিটারটি দেখতে দেন আইয়ুব বাচ্চুকে। গিটারটি হাতে নিয়ে বাচ্চু বাজাতে শুরু করেন। এমনভাবে দরদ দিয়ে বাজালেন পুরো মার্কেটে লোকজন জড়ো হয়ে যায় আমেরিকাবাসীরা অবাক এতো সুন্দর গিটার বাজানো দেখে। এবার দোকানদারকে বাচ্চু বললেন, তুমি অসাধারণ বাজাও, এই গিটার তোমার জন্যই। তুমাকে হাফ দামে দেব। এবার আইয়ুব বাচ্চু বিনয়ের সাথে বললেন, এটা তুমি আমাকে বিনে পয়সায় দিলেও আমি নেব না। তুমি আমার দেশকে অপমান করেছে। যে গিটারের জন্য আমার দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আইয়ুব বাচ্চু বিনাপয়সায় নিবে না এবং দ্বিতীয়বার বাজাবেও না।
গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামে এবি লাউঞ্জ করতে চেয়েছিলেন নব্য ব্যান্ড শিল্পীদের জন্য। যেখানে নব্য গায়করা গিটার বাজাবে গাইবে। তাঁর পটিয়া গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল করারও স্বপ্ন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। বাচ্চুর স্বপ্নগুলো পূরণ করা হয়নি। স্বপ্ন থেকে গেলো। ১৮ অক্টোবর লক্ষ কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলেগেলেন। ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। আইয়ুব বাচ্চু ভক্তদের প্রাণের দাবী “এবি লাউঞ্জ” নামে চট্টগ্রামে গিটার একাডেমি স্থাপন করা হোক।
রশীদ এনাম
লেখক ও প্রাবন্ধিক।