Cvoice24.com

৬১তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা 
আঁরার ছড়ার ‘জাদুকর’ রাশেদ রউফ

রশীদ এনাম

প্রকাশিত: ১৭:২১, ৩ জানুয়ারি ২০২৫
আঁরার ছড়ার ‘জাদুকর’ রাশেদ রউফ

শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফকে লেখকের (মাঝে) উপহার; ডানে শিশুসাহিত্যিক ইসমাইল জসিম।

ছনহরা গ্রামে নাকি একসময় ছনের চাষাবাদ হতো। ছনঘরের ছাউনি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত খড়জাতীয় তৃণ। হরা-হরণ করা। কোনো একসময় কেটে রাখা ছনপাতা চুরি হয়েছিল, সেই থেকে গ্রামের নামকরণ হয় ছনহরা। 

পটিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বৈলতলী রোড বা আনোয়ারা রোড হয়ে যাওয়া যায়। বাইপাস রোড থেকে দক্ষিণ পাশে ২ থেকে ৩ কিলোর পথ। সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা ছায়াঘেরা ছবির মতো দক্ষিণ ছনহরা গ্রামখানি। রাস্তার পাশে সবুজ ধানক্ষেত, সারি সারি নানা রকমের  বৃক্ষরাজি, যাওয়ার পথে ভাটিখাইন ইশকুল, অমল চৌধুরী  মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট, দীঘি, পুকুর, আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার পথে, সোনালি ধানের ফসলে ভরে গেছে মাঠ। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। কিষান-কৃষানিরা ফসল তুলতে ব্যস্ত। 

কৃষকরা মেঠোপথ ধরে পাকা ধান কাঁধে নিয়ে ছুটছে। সোনালি ধানগুলো নৃত্য করছে। জমিতে ধান কাটার পর নাড়া থাকা শুকনো খড় বিশেষ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অনেকে নাড়া বা শুকনো খড় কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। ধানিজমিতে কিছু কিছু জায়গায় পানি আর কাদা জমে আছে। জমিতে শুভ্র বর্ণের এক ঝাঁক বক মাছ শিকারে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মাছ ধরে গাপুসগুপুস করে গিলছে। হিজল গাছে ডাকছে ঘুঘু পাখি।  

এজন্য বোধহয় কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন— “পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে, পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে, পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে, আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে”।

কেরাঞ্জা খালের উপর ব্রিজ চোখে পড়ল কিছুদূর গেলে ছনহরা ১ নং ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। একটু সামনে গেলে বিশাল আকারের খেলার মাঠ পাশে ১৯৬৬ সালে নির্মিত টিনের ছাউনি ছনহরা ষোড়শী বালা উচ্চ বিদ্যালয়, পাশে ছনহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। 

এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ। একটু সামনে গেলে ছিকন খলিফা মাদ্রাসা ও মাজারের ফটক। কিছুদূর গেলে ছোটো একটা পুকুর পাশে মসজিদ, পুকুরের পূর্বপাশে অনেক পুরানো দিনের দোতলা পাকা বাড়ি, উঠোনে ধানের ঘোলা, পাশে, পাশে আমগাছ, এলাচি লেবুর গাছ। লেবু পাতার মাঝখানে সবুজ লেবু দুলছে। বাড়ির ছাদে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক কবুতর। ছাদে কবুতরের খোপ চোখে পড়ল। এই বাড়িতে জন্মেছিলেন আমাদের কীর্তিমান শিশুসাহিত্যিক ছড়ার জাদুকর রাশেদ রউফ ভাই। 

জন্মকথা:  দেশবরেণ্য শিশুসাহিত্যিক ছড়ার জাদুকর রাশেদ রউফ ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি পটিয়া ছনহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজি নূর ছৈয়দ, মাতা মাবেয়া বেগম। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক, গ্রামের বিচার সালিশ করতেন। ভাইদের মধ্যে সবার বড়ো। বাবা-মায়ের ভীষণ আদুরে ছেলেটির শৈশব কৈশোর কাটে ছনহরা গ্রামে। দুরন্ত দস্যিপনা দিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বইপ্রেমী। 

শিক্ষাজীবন: শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফের পড়ালেখার হাতেখড়ি ছনহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন, ১৯৭৯ সালে ছনহরা ষোড়শী বালা উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি এবং ১৯৮১ সালে পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮৬ সালে সম্মানসহ বিএসসি পাশ করেন, ১৯৮৭ সালে গণিত বিষয় নিয়ে মার্স্টাস পাশ করেন। 
গণিত বিষয় নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি মেধাবী তরুণ রাশেদ রউফ বই পড়ার পাশাপাশি লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম দিকে ‘পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে ছড়া লিখতেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। নিয়মিত লিখতেন। লেখালেখির পাশাপাশি বই পড়া এবং সাহিত্যচর্চা দুটোই চলতে থাকে।

খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকের কীর্তি:  রাশেদ রউফ ভাই একাধারে সাংবাদিক, কবি, লেখক, ছড়াকার, সম্পাদক এবং সাহিত্যেপ্রেমীদের একজন, ভালো সংগঠক, সাহিত্যের প্রত্যেকটি সিঁড়িতে  তিনি বিচরণ করে রচনা করেছেন ৬০টিরও বেশি বই। তাঁর সবচেয়ে বড়ো কীর্তি চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা। 

শৈলী প্রকাশন নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। শৈলী বেশ স্বনামধন্য প্রকাশনা। শৈলীর উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় উৎসব উপলক্ষ্যে বই উৎসব ও সাহিত্য মেলা, সাহিত্য সভা, সেমিনার নতুন বইয়ের পাঠ উন্মোচনসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। ছড়ায় ছড়ায় শুদ্ধাচার বই এ রাশেদ ভাই লিখেছেন, 

“কারা করে চাঁদাবাজি
কারা করে হত্যা
তাদের দমন চাই
চাই নিরাপত্তা।”

রাশেদ ভাই এর আরো একটি অসাধারণ ছড়া আমার খুব প্রিয়

“আমার বাবা আছে, আছে প্রিয় মা 
অনাবিল সুখ আছে, নেই ভাবনা 
কখনো ঘুড়ির মতো উড়ে চলি অবিরত

মেঘের পানসি হয়ে আকাশে ভাসি 
আসমানে ঢেউ খেলে রোদের হাসি। 

ছড়া জাদুকরের অর্জন: ভালো  কাজ করলে একদিন মূল্যায়ন হবে। শিশুসাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে রাশে ভাইয়ের পদচারণা। ইজ্জত দেওয়ার মালিক স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তা। রাশেদ ভাই গত ২০১৬ সালে শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সেরা লেখক,  শিল্পকলা একাডেমি পদক, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, পদ্মবীণা সাহিত্য পদক, বাংলা সাহিত্য পদকসহ নানা সংগঠন থেকেও গুণী  লেখক হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন।

আমার অনুভুতিতে রাশেদ রউফ ভাই: রাশেদ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় খুব সম্ভবত সৃজনশীল সাহিত্য গোষ্ঠী মালঞ্চ-র সাহিত্য সভায়। কী সুন্দর করে অন্ত্যমিল ছড়া আবৃত্তি করতেন। ভাইয়ের একটা বই ছিল হলুদ কভারের ছন্দ পরিচয়। বইটি আমি সংগ্রহ করেছিলাম। শৈলীর লুসাই ভবনে। কখনো বইমেলায় কখনো-বা পটিয়ায় কখনো ঢাকার নানা অনুষ্ঠানে। 

রাশেদ ভাইয়ের সবচেয়ে বড়ো গুণ তিনি মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পছন্দ করেন। ভাইয়ের সরলতা বিনয়ী মুচকি মিষ্টি হাসি দিয়ে কথা বলার ভঙ্গি। আমার দুলাভাই আবদুল মালেক রানা ভাইয়ের খুব কাছের বন্ধু হওয়াতে রাশেদ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করেন। ভাইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করেন। লেখালেখির জন্য চট্টগ্রামে আমার মনে হয় না রাশেদ ভাইয়ের মতো কেউ এত অনুপ্রাণিত করেন লেখালেখির জন্য উৎসাহ দেন। 

বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামে যাঁরা নিয়মিত লিখছেন তাদের সবাইকে একটা প্ল্যাটফরম করে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় তিনি যাঁরা নতুন লিখছেন তাঁদের সবাইকে দিক নির্দেশনা দেন। নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার পর সেই বইয়ের পাঠ উন্মোচন, বইয়ের আলোকপাতসহ নানা প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লেখকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে চলেছেন। এসব অনুষ্ঠানের বড়ো একটা প্ল্যাটফর্ম হলো চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম শিশুসাহিত্য একাডেমি। 

আমার কাছে মনে হয় সাহিত্যে নিয়ে যাঁরা ভাবেন নিয়মিত লিখছেন সবাইকে রাশেদ ভাইয়ের তাঁর ভালোবাসার গড়া শৈলী নামক সাম্পানের যাত্রী করেছেন অনেক যাত্রীকে। শুধু তাই নয় রাশেদ ভাই আবার অনেক মেধাবী নাবিকও রেখেছেন পালতোলা সাম্পানের। সে পালতোলা তরির যাত্রী আমি নিজেও, কীর্তিমান রাশেদ ভাই আমার কাছে অনুপ্রেরণার এক বটবৃক্ষ যার ছায়া প্রতিনিয়ত আমি উপভোগ করি। 

দীপ্তিমান রাশেদ ভাইয়ের হাত ধরে আজ অনেক লেখক, সাংবাদিক, কবি, ছড়াকার বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা অনেকে আজ চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সমগ্র দেশেও পরিচিত হয়েছেন। রাশেদ ভাই শিশুসাহিত্যের বরপুত্র যাকে আমি সবসময় আমাদের ছড়ার জাদুকর বলে সম্বোধন করি। যিনি প্রতিনিয়ত শব্দ কামারের মতো শব্দ পিটিয়ে শান করে একের পর এক ছড়া রচনা করে চলেছেন। 

শুধু তাই নয়, রাশেদ ভাই আজ সমগ্র দেশ ছাড়িয়ে ওপার বাংলায় পরিচিত লাভ করেছেন। শিশুসাহিত্যের কাউকে লেখালেখিতে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করার ব্যাপারে কখনো কৃপণতা করতে দেখিনি। কেউ লিখতে চাইলে তাঁকে বিভিন্নভাবে লেখালিখির সুপরামর্শ এবং ভালো মানের বই পড়ার পরামর্শসহ নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। সবাইকে তিনি বই পাঠে মনোযোগী এবং বেশি বেশি বই পড়ার জন্য বই সংগ্রহের জন্য বই উপহার দেওয়ার জন্য নাড়া দেন। 

প্রিয় রাশেদ ভাই প্রিয় ছড়াকার বড্ড পছন্দের বিনয়ী ভালোমানুষ আমাদের ছড়ার জাদুকর খ্যাত রাশেদ রউফ ভাইয়ার শুভ জন্মদিন।  আমি জানি এত বিশাল লেখা পড়তে অনেকের উৎসাহ হবে না। লেখালেখি করে যতটা অনুপ্রেরণা অর্জন যে পরিমাণ মনের খোরাক সুখ অনুভূতির জন্ম দিয়েছে এবং যতটা  আমাকে লেখার আনন্দ দিয়েছে রাশেদ ভাইকে নিয়ে কম করে লিখলে কৃপণতা হবে। 

আমি মনে করি ভালোর প্রশংসা আকাশ পরিমাণ করা উচিত। আমি যতটুকু না লিখছি তার চেয়েও ঢের বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সম্মান রইল রাশেদ ভাই আপনার প্রতি। রাশেদ ভাইকে নিয়ে একবার  কবিতা লেখার দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম আমি যা অনেকটা অরণ্যে রোদন করা

 এক যে ছিল ছড়ার জাদুকর
শব্দ পিটিয়ে বানায় সে ছড়ার ঘর
পড়ি আমি তাঁর অন্ত্যমিল
খুশিতে মন করে ঝিলমিল।
পটিয়া ছনহরা গ্রামের সেই ছেলেটি
 দেশজুড়ে যার আছে খ্যাতি
কীর্তিমান শিশুসাহিত্যিক প্রিয় রাশেদ রউফ ভাই
এসো  হে সুহৃৎ সবাই মিলে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই! 

 আপনার জন্মদিনটি বারবার ফিরে আসুক। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনার রিজিক ও হায়াতে বরকত দান করেন। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। 
       
রশীদ এনাম
লেখক ও প্রাবন্ধিক।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: