Cvoice24.com

জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না চট্টগ্রামের মাদ্রাসায়, উপেক্ষিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ২ মার্চ ২০২২
জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না চট্টগ্রামের মাদ্রাসায়, উপেক্ষিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ

হাটহাজারীর আলীপুরে ইসলামিয়া আরবীয়া তা’লীমুল কোরআন মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম চললেও উত্তোলন হয়না জাতীয় পতাকা।

২ মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। গুণে গুণে স্বাধীনতার ৫০ পেরিয়ে ৫১ বছরের পথে বাংলাদেশ। জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ আছে, অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা রোজ ওঠানো নামানোর নিয়ম। ইতিহাসবিদরাও বলছেন— সংবিধানে জাতীয় পতাকার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার এবং এর নিয়ম কানুন আছে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি কার্যদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নিয়ম থাকলেও ব্যতিক্রম কেবল মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। 

স্বাধীনতার এত বছর পরেও জাতীয় পতাকা ‘ঠাঁয়’ পায়নি চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে। কোথাও বা পতাকার স্ট্যান্ড থাকলেও ওড়ে না জাতীয় পতাকা। যদিও গত বছরের ৪ মার্চ মাদ্রাসার প্রাত্যাহিক কাজ শুরু করার আগে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করার জন্য সুপারিশ করেছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি। কিন্তু সে সুপারিশের একবছর কেটে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকিও কমিটির সদস্যরাও এ বিষয়ে আর খবর রাখেননি। 

চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, দেওয়ানহাট এলাকার বায়তুশ শরফ, আল আমিন বারিয়া কামিল মডেল মাদ্রাসা, দারুল আরকাম তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসা, এরাবিয়ান লিডারশীপ মাদ্রাসা, জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহর মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন সুন্নী, আলিয়া, কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত ছিল মাদ্রাসার আঙ্গিনা। প্রতিটি মাদ্রাসায় হাজারের উপরে ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের কোনটিতে পতাকার স্ট্যান্ডই চোখে পড়েনি। আবার কোথাও স্ট্যান্ড থাকলেও অস্তিত্ব ছিল না পতাকার। এমনকি অনেক শিক্ষার্থীর জাতীয় পতাকা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। সরেজমিনে মাদ্রাসায় পতাকার অস্তিত্ব না মিললেও কর্তৃপক্ষের ছিল নানা অজুহাত। জাতীয় পতাকা টাঙ্গানোর কথা জানতে চাইলে মাদ্রাসা বন্ধ অথবা দোতলায় আছে— মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এমন বক্তব্য দিলেও শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার চিত্র চোখে পড়েছে।

নুরানী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেও মেলে অবাক করা তথ্য। পাঁচ-ছয় বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না জাতীয় পতাকার বিষয়ে। জাতীয় পতাকা কি?— উল্টো এমন প্রশ্নই ছুঁড়ে দিয়েছে প্রতিবেদককে। 

 জামেয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় পতাকার দুটি স্ট্যান্ড থাকলেও কোনটিতে নেই জাতীয় পতাকা।

নগরের ষোলশহর এলাকার জামেয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় পতাকার দুটি স্ট্যান্ড থাকলেও কোনটিতে ছিল না জাতীয় পতাকা। মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় কিনা জানতে চাইলে ওই মাদ্রাসার নুরানী বিভাগের এক শিক্ষার্থী সিভয়েসকে বলেন, ‘জাতীয় পতাকা কী?’। একথা বলে অন্যদিকে দৌড়ে চলে যায় ওই শিক্ষার্থী। তার পাশে থাকা আরেক শিক্ষার্থীর কাছে একই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা আছে। তবে তা সব সময় ওঠানো হয় না। মাঝে মাঝে ওঠানো হয়।’

এ বিষয়ে জামিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ অসিউর রহমান সিভয়েসকে বলেন,‘আমি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অবসরে গিয়েছি। বর্তমানে লিয়াকত আলী সাহেব দায়িত্বে আছেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে যেহেতু আমি অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলাম মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট ছিলাম। মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে আমরা সচেতন ছিলাম, এখনো আছি। আমরা যেহেতু একটা স্বাধীন দেশে বাস করছি, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পতাকা তুলতেই হবে। শুধু তাই নয় আমরা ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। শহীদদের জন্য দোয়াও কামনা করা হয়।’

চান্দগাঁও থানার বাহির সিগনাল এলাকার সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা আল আমিন বারিয়া কামিল মডেল মাদ্রাসা। অথচ এই মাদ্রাসার পুরো আঙ্গিনা ঘুরে জাতীয় পতাকা দূরে থাক কোন স্ট্যান্ডই ছিল না। তবে পতাকা উত্তোলন করা হয় এমন দাবি করে ১ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইসমাইল সিভয়েসকে বলেন, ‘আগামীকাল ২ মার্চ থেকে আমাদের মাদ্রাসায় ওরশ অনুষ্ঠিত হবে। তাই বর্তমানে আমাদের মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে। তবে মাদ্রাসা খোলা থাকলে আমরা পতাকা উত্তোলন করি। এসব নিয়ম আমরা মেনে চলি।’

নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার দারুল আরকাম তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ আক্কাস উদ্দীন সিভয়েসকে বলেন, ‘সকালে মাদ্রাসার কার্যক্রমের শুরুতে আমরা জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা উত্তোলন করি। এ কাজটি নিয়মিত করা হয় আমাদের মাদ্রাসায়।’

একই রকম এরাবিয়ান লিডারশীপ মাদ্রাসার মূল ফটকে পতাকা স্ট্যান্ড থাকলেও ছিল না পতাকা। তবে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক এনামুল হক মাদানি সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রতিদিনই আমরা শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আগে সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।’

এদিকে হাটহাজারীর বড় কওমি মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা, মীরেরহাটের আল-হুদা মহিলা মাদরাসা, মা’হাদুত তাক্বওয়া মাদরাসা, আলীপুরে ইসলামিয়া আরবীয়া তা’লীমুল কোরআন মাদরাসা, মদনহাটের ফতেপুর মনজুরুল ইসলাম সিনিয়র মাদ্রাসাসহ বেশকিছু মাদ্রাসায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো মাদ্রাসাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। সেই সাথে নেই কোনো পতাকার স্ট্যান্ড। অথচ সকাল থেকেই প্রতিটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। 

হাটহাজারীর আলীপুরে ইসলামিয়া আরবীয়া তা’লীমুল কোরআন মাদরাসার একাধিক শিক্ষার্থী স্বীকার করেছেন, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। 

তবে ফতেপুর মনজুরুল ইসলাম সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল আওয়ালের দাবি, ‘আমাদের মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।’

কিন্তু সরেজমিনে দেখেছি কোনো পতাকা দণ্ডই নেই এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই তলায় আমরা পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা রেখেছি। আমরা জাতীয় সংগীত পরিবেশনা করেই দিনের কার্যক্রম শুরু করি।’  

হাটহাজারী পৌরসভার পশ্চিম ফটিকার তাহসিনুল কোরআন মাদ্রাসার পরিচালক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি আগামী মাস থেকে আমাদের মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য। আমাদের ছাত্ররা এতে আগ্রহী আছে। আমরা প্রতিষ্ঠানের কমিটির সাথে কথা বলে অতিসত্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।’ তবে তিনি নিজের নাম বলেননি। 

এদিকে গত বছরের মার্চে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ সকল মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশন নিশ্চিত করতে সুপারিশ করে।

এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি ও পটুয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ ১ মার্চ সিভয়েসকে বলেন, ‘আসলে এটা এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। আমি আগামীকাল (২ মার্চ) ঢাকায় যাচ্ছি। তারপর রোববার দিন একটা চিঠি দিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিবো। আসলে এটার ইন্সট্রাকশন তো আমাদের কাছে থাকে না। এটা কার্যকর করবে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। আগামী রোববার দিন চিঠি জানতে চাইবো এ ব্যাপারে কি কি কাজ হলো এবং তা যেন আগামী তিনদিনের মধ্যে আমাদের জানায়।’ 

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোতে অনীহা কেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা খুব দুঃখজনক। পাকিস্তান আমলে অতীতে এ ধরনের ঘটনা দেখি নাই। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে যে দেশটা স্বাধীন হলো জাতীয় পতাকা নিয়ে তাদের এত অনীহা কেন, কেন তারা এটা করেনা? আসলেই এটা আমাদের কাছেও প্রশ্ন জাগে। যেখানে যেখানে জাতীয় পতাকা নাই, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’ 

একই বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান সিভয়েসকে বলেন, ‘জাতীয় পতাকা বা মুক্তিযুদ্ধের সাথে মাদ্রাসার কোন বিরোধ থাকার কথা না। ধর্মের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোন বিরোধ নাই। তবুও যারা এ বিরোধ তৈরি করে তাহলে তারা বাংলাদেশকে মানে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অনেক মাওলানা সাহেব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এখনকার মাওলানা সাহেবেরা কোথায় পেলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় বিরোধী কাজ’? মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা তুলতে হবে এবং তা বাধ্যতামূলক করা উচিত। আর এটা মনিটরিং করার দায়িত্ব প্রশাসনের। মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা না তুললে তাদের বোঝাতে হবে। নয়তো তাদেরকে বলতে হবে কেন তারা জাতীয় পতাকা তুলতে চান না! পতাকা না তোলা মানে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ করা।’ 

এক প্রশ্নের জবাবে হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘দেশ কেবল পিছিয়েই যাচ্ছে। সবদিক দিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছে। একমুখী প্রাথমিক ও গণমুখী শিক্ষা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। অথচ সে জায়গায় রাষ্ট্র নাই। এখন প্রশাসনের তদারকির ভীষণ প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাদেরকে কঠোর হতে হবে।’ 

মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদকে একাধিক ফোন ও মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

একই বিষয়ে জানতে চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপুমণি এমপি ও উপ মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে একাধিবার কল করা হয় ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়