কালুরঘাট সেতুতে ভুতুড়ে অন্ধকার, জানে না রেলওয়ে 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ২৮ জুন ২০২১
কালুরঘাট সেতুতে ভুতুড়ে অন্ধকার, জানে না রেলওয়ে 

এক বছর ধরে সন্ধ্যা হলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে কালুরঘাট সেতুতে। ছবি : সিভয়েস।

একে তো পশ্চিম থেকে পূর্ব পাশ পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে সেতুর বিভিন্ন অংশ। সাথে রাতের অন্ধকারে জ্বলছে না বৈদ্যুতিক বাতি। অথচ জরাজীর্ণ এ কালুরঘাট সেতুতে রাতদিন সমান তালে চলছে ভারী ট্রাক, ছুঁটছে ট্রেনও। এসবের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় ২৩৯ মিটার এ সেতুতে প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করছে বোয়ালখালী ও পটিয়ার একাংশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ। তাদের ভাষায়—এটা কোন সেতু নয় জীবন মৃত্যুর পুলসিরাত!

কেননা গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুতে হরহামেশাই ঝরছে তাজা প্রাণ। সম্প্রতি জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুতে ট্রেন চাপায় একজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর এবার খবর বেরিয়েছে —রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেতু থেকে পড়ে এক নারী হারিয়ে গেছে কর্ণফুলীর স্রোতে। অথচ রাতের অন্ধকারে এ সেতুতে লাইট না জ্বালানোর প্রেক্ষিতে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা নির্দ্বিধায় বলেছেন— জরাজীর্ণ এ সেতুতে বাতি জ্বলছে না সেটা তাদের জানা নেই।

এদিকে রোববার (২৭ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কালুরঘাট সেতু এলাকায় ওই নারী পড়ে যাওয়ার খবর চাউড় হলে সেখানে একে একে হাজির হয় পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তবে এ ঘটনার পরদিন (২৮ জুন ) দুপুর পর্যন্ত রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কি হয়েছিল তা নিশ্চিত হতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশ জানায়, রাতের অন্ধকারে কালুরঘাট সেতু থেকে এক নারী পড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যায় চান্দগাঁও থানা পুলিশের একটি দল। পরে সেখান থেকে এক কিশোরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু ‘প্রতক্ষ্যদর্শী’ কিশোরী তাসপিয়া (১৪) পুলিশের বিভিন্ন প্রশ্নের অসংলগ্ন উত্তর দিয়েছে।  

চান্দগাঁও থানা পুলিশের এসআই রফিক সিভয়েসকে বলেন, ‘এ ঘটনায় মেয়েটি ঠিক মত কিছু বলতে পারছে না। গ্রহণযোগ্য কিছু বলেনি সে। মেয়েটি বলছে আশপাশের লোকজন একজন নারীকে পড়ে যেতে দেখেছে। আবার বলছে পড়ে যাওয়া মেয়েটি তার বান্ধবী। পরে মেয়েটিকে আমরা ঘরে পৌঁছে দিয়েছি।’ 

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কালুরঘাট সেতু থেকে কেউ পড়ে গিয়েছিল কি’না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলবো? হতেও পারে, নাও হতে পারে। কারণ মেয়েটা কিছুই সঠিকভাবে বলতে পারছে না।’ 

ওই একই সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিল ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। তারাও বলছেন— ঘটনাস্থলেই ‘প্রতক্ষ্যদর্শী’ কিশোরী একেকবার একেক রকম তথ্য দিয়েছে। তাই বিভ্রান্তির মুখে কর্ণফুলী নদীতে উদ্ধার তৎপরতা কিংবা পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যায়নি।

কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. কাজল মিয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। ওখানে মেয়েটিকে (তাসপিয়া) পেয়েছি, সে তথ্য দিয়েছিল পড়ে যাওয়া মেয়েটি তার সাথেই ছিল, তার বান্ধবী। কিন্তু মেয়েটি একেক সময় এক এক রকম তথ্য দিচ্ছিল। পরে সঠিক তথ্য পেতে তাকে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।' 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ কাজী নুরুল আমিন সিভয়েসকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ আমাকে ফোন করেছিল। পরে রাত ১২টার দিকে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তখন প্রতক্ষ্যদর্শী মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাই আমি মেয়েটির সাথে কথা বলতে পারিনি। আমি ক্লিয়ার না যে ঘটনাটা কি। পরে ফায়ার সার্ভিসকে আমি বলেছি, পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে। তাদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে।’

এদিকে স্থানীয়রা দাবি করেছেন, গত বছরের বেশ কয়েক দফা সংস্কার কাজ চলাকালীন সময়ে কালুরঘাট সেতুতে বাতি লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার দু’দিন পরে উধাও হয়ে যায় সেতুর বৈদ্যুতিক খুঁটিতে থাকা বাতিগুলো। সে হিসেবে প্রায় এক বছর ধরে সন্ধ্যা হলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে কালুরঘাট সেতুতে। 

তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এডিশনাল চীফ ইঞ্জিনিয়ার (ব্রিজ) আহসান জাবির সিভয়েকে বলেন, ‘এ অভিযোগ সত্য নয়। ওই সময়ে হয়তো কাজের স্বার্থে বাতি জ্বালানো হয়েছিল। এমনে বাতি ছিল না।'

গত শুক্রবার সরেজমিনে পুরো সেতু হেঁটে পরিদর্শনে দেখা যায়, পুরো সেতু অন্ধকারচ্ছন্ন। কয়েকটা এলইডি লাইট দেখা গেলেও একটিও জ্বলছে না। গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ওই সেতু দিয়ে লোকজন ঝুঁকি নিয়ে হাটছেন। উভয় পাশের ডেক এবং লোহার বেড়া প্রায়শই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেকে পা পিছলে নদীতে পড়তে গিয়েও আবার সাবধান হয়ে রক্ষা পাচ্ছেন। কেননা ওই সেতু দিয়ে কার বা মাইক্রো গাড়ি গেলে বেশি জায়গা না থাকায় এসব লোহার বেড়া ধরেই দাঁড়াতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ স্থানেই লোহার পাইপ নেই আর গাছ নেই। সে কারণে যেকোনও মুহুর্তে পা ফসকে নদীতে পরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

সেতু নির্মাণ নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর উপরে ব্রিটিশ-যুগের সেতুটি ব্যবহার এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এবং অনেক সময় ধরে এ অবস্থা চলছে। উভয় পাশের ডেক এবং লোহার বেড়া প্রায়শই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং সেতুর সারফেসে গর্ত তৈরির ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় সেতুটি দিয়ে চলাচল করা কয়েকশো যানবাহনকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চলাচলের উপযোগী রাখার জন্য কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যেই সেতুটিকে মেরামত করতে হয়। ষোলশহর থেকে দোহাজারী অংশে যেখানে সেতুটি অবস্থিত সেখানে রেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩০ কিলোমিটার। বোয়ালখালী উপজেলা, পটিয়ার পূর্ব এবং রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মানুষের নদী পার হওয়ার জন্য সেতুটির বিকল্প নেই।

জানতে চাইলে কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম পাড়ের লাইনম্যান বলেন, ‘ব্রিজে কোনও লাইট নেই। কয়েকটি থাকলেও সেগুলো নষ্ট হওয়ায় জ্বলে না।’

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বোয়ালখালীর চরণদ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাহেদ বলেন, এ ব্রিজটি বোয়ালখালীবাসীর জন্য অভিশাপ। নতুন ব্রিজতো হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার মানুষ পায়ে হেঁটে যে ব্রিজটি পার হবে তাও পারছে না। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ব্রিজটি।’ 

ব্রিজ পার হতে হতে মোহাম্মদ আসিফ নামে এক পথচারী বলেন, ‘রেলওয়ের মানুষজন কি এসব দেখে না। ব্রিজ পার হতে গিয়ে অন্ধকারে যেকোনও সময়ে যে কেউ নদীতে পরে যেতে পারে।’ 

তবে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ব্যাপারে জানতে দুপুর ১২টার দিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘সেখান থেকে কিভাবে পড়ে গেল? আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি বিষয়টি।’ 

পরে ৩টার দিকে ফের যোগাযোগ করা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘আলোকায়নের বিষয়টি রেলওয়ের ইলেকট্রনিক্যাল বিভাগের দায়িত্বে। আমি তাদের বলে দিয়েছি কালুরঘাট সেতুতে যেন বাতি লাগিয়ে দেওয়া হয়।’

-সিভয়েস/এপি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়