জনগণের ভালোবাসায় অনেকদূর এগোতে পারবো: কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা

প্রকাশিত: ১৫:১১, ১৬ এপ্রিল ২০১৮
জনগণের ভালোবাসায় অনেকদূর এগোতে পারবো: কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা

স্থানীয়দের সাথে কুশল বিনিময় করেন সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ নং খাগড়াছড়ি আসন থেকে নির্বাচিত হন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। নির্বাচনের পর থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন তিনি। সংসদ অধিবেশনে নিয়মিত উপস্থিতি ছাড়াও বেশিরভাগ সময় তিনি এলাকাতেই অবস্থান করেন। জেলার সার্বিক উন্নয়ন, গণসংযোগ এবং সভা-সমাবেশ ছাড়াও অংশ নেন প্রচুর সামাজিক অনুষ্ঠানে। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিগত দিনের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং আগামী দিনের চলার পথের অগ্রাধিকার স্বপ্নের কথাগুলো জানিয়েছেন সিভয়েসের সাথে একান্ত আলাপচারিতায়।  

প্রথমেই তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হবার আগে বিভিন্ন জনসভায় জেলার অর্থনীতি এবং সর্বসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, এই জেলার কৃষি, বাঁশ ও কাঠ, পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এবং নান্দনিক পর্যটন ঐশ্বর্যকে কাজে লাগিয়ে বড় রকমের পরিবর্তন সম্ভব। ব্যবসা, ক্ষুদ্রশিল্প এবং পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে খাগড়াছড়িবাসীর জীবনমান পাল্টানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। 

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনরা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে তার (শেখ হাসিনা) আন্তরিকতায় সত্যি সত্যি পাল্টে গেছে খাগড়াছড়ির চিত্র। জেলার সাথে প্রতিবেশী জেলা, জেলার সাথে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন এবং প্রত্যন্ত এলাকার সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের ফলে মানুষের যোগাযোগ সহজতর হয়ে উঠেছে। উৎপাদিত কৃষিজ-বনজসহ অন্যান্য পণ্য সহজে-সুলভে পরিবহন, বিপণন এবং সংরক্ষণের পথ প্রশস্ত হয়েছে।  

রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি বলেন, বর্ণিল ভাষা-সংস্কৃতি আর জীবনাচারের জনপদ খাগড়াছড়ি। মুসলিম-হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা’র জাতিগত বৈচিত্র্যের কারণে দেশে-বিদেশে সমান পরিচিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। রাজনীতি আর সংঘাতের জন্যও অনেকবার মিডিয়ার শিরোনাম ছিলো খাগড়াছড়ি। তাই এই জেলার মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতা অনেক বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

তার মেয়াদে শিক্ষার অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেলায় সরকারিকরণ করার মতো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বললেই চলে। উপজেলা সদরের সবকটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজ, হাইস্কুল জাতীয়করণ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এলাকায় শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। প্রতিটি উপজেলা এবং ইউনিয়নে ব্যক্তি ও সামষ্টিক উদ্যোগে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। আর এতেই প্রমাণিত হয়, খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শিক্ষায় রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়েছে। 

মানুষের ব্যবসা-সম্পদ-জীবন এবং আবাসনের নিরাপত্তায় দীঘিনালা, মাটিরাঙা, মহালছড়ি, লক্ষীছড়িতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ইউপি কমপ্লেক্স নতুন রূপ পেয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকাতেও পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসূচি- কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে ওষুধ ও সেবা কার্যক্রম।  

তিনি বলেন, এর আগে বেশ ক’বছর পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ যেমন কাছ থেকে বুঝতে পেরেছি, তেমনি মানুষের অমিত সম্ভাবনাও জানা হয়েছে। তবে খাগড়াছড়ির সব শ্রেণী-পেশার মানুষই ব্যক্তি উন্নয়নের চেয়ে সামষ্টিক উন্নয়নে প্রত্যাশী। 

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজের অবস্থান ও অভিজ্ঞতা থেকে মনে করেন, খাগড়াছড়ি জেলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং তথ্য-প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দেশ স্বাধীনের ৪৬ বছরের মাথায় জেলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। গ্রিড সাব স্টেশন চালু হয়েছে। আশা করছি, আগামী নির্বাচনের আগেই জেলার বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। 

তাছাড়া প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সময়োপযোগী আধুনিকায়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণকে প্রয়োগের সুযোগ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে আমাদের সরকারেরও বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। 

তিনি পার্বত্য এলাকার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দায়বোধ এবং ঐতিহাসিক ‘শান্তিচুক্তি’র প্রসঙ্গ টেনে বলেন, পাহাড়ের অনেক সমস্যা যেমন এখনো অমীমাংসিত আছে, তেমনি এসব সমস্যার গভীরতাও অনেক বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারই পাহাড়ি-বাঙালি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখে। তিনি বলেন, ‘দলও আমাদের, সরকারও আমাদের। সংসদ এবং সচিবালয়ের দরজা তো খোলা থাকবে। তাই জনগণের ভালোবাসায় হয়তো সংসদ সদস্য হিসেবে অনেক দূর এগোতে পারবো’।    

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র বেড়ে ওঠা: 

স্বচ্ছল কৃষি পরিবারের সন্তান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আশি’র দশকে কর্মজীবন শুরু করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা হিসেবে। বাবা প্রয়াত হরি কুমার ত্রিপুরা ও মা উমাদেবী ত্রিপুরা’র তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। কলেজ জীবনে থাকার সময় থেকেই তিনি নানামুখী সামাজিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হন সকলের। ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি খাগড়াছড়ি স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদ)-এর নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। 

১৯৮৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজসহ দীঘিনালা উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনে তার অবদান স্মর্তব্য। 

নিজের শ্রম-অধ্যবসায় আর একাগ্রতায় মাত্র এক দশকের ব্যবধানে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি-বাঙালি সবার কাছেই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। নব্বই দশকে রাজনীতি ও ব্যবসায় তার উত্থান ঘটে। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও দলে তার প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা সবাইকে ছাপিয়ে যায়। আর এই কারণেই ২০০১ সাল থেকে নেতাকর্মীদের অনুগ্রহে খাগড়াছড়ি আসনের নির্বাচনী দৌড়ে তিনিও শামিল হন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয় খাগড়াছড়িতে। বিএনপি নেতাকর্মীদের অমানুষিক নিপীড়ন-নির্যাতনে খাগড়াছড়ি হয়ে পড়ে একেবারে আওয়ামী লীগ শূন্য। ২১ জন নেতাকর্মীকে হত্যা, শত শত মামলা আর কয়েক হাজার নেতাকর্মী হন বাড়িঘর ছাড়া। খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পার্বত্যমন্ত্রী এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগ। 

সময়ের প্রয়োজনে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকেই তখন ধরতে হয় জেলা আওয়ামী লীগের হাল। ২০০৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সব আয়োজন নিজের গাঁটের পয়সায় করলেও, সফল হতে পারেননি নিজে। তারই পিতৃতুল্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা সভাপতি পদ দাবি করায় তাকে (কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা) ছাড় দিতে হয় প্রত্যাশিত পদটি। একইভাবে ২০০৬ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেলেও দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে বাতিল হয়ে যায় সেই নির্বাচন। ২০০৮ সালে মনোনয়ন দৌড়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও তিনি মনোনয়নের মুখ দেখেননি। গত মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন। সেই সুবাদে ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কাউন্সিলরদের বিপুল ভোটে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে হারিয়ে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি ৯৯ হাজার ৫৮ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

শিক্ষিকা স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরা, দু’মেয়ে আর দু’ ছেলে নিয়ে তার সুখের সংসার। 

সিভয়েস/রাজীব/এমআইএম

87

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়