হালদার চার প্রজাতির মাছ ও ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন করল চট্টগ্রামের গবেষকদল

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ১৬ নভেম্বর ২০২১
হালদার চার প্রজাতির মাছ ও ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন করল চট্টগ্রামের গবেষকদল

ফাইল ছবি

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর কার্প জাতীয় চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্স) করেছেন চট্টগ্রামের একদল গবেষক। কার্প জাতীয় এ মাছগুলোর জীবনরহস্য উন্মোচনের জন্যে প্রায় দুই বছর ধরে চলা এ গবেষণায় অর্থায়ন করেছে পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। এ গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী। এছাড়াও এ গবেষণায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সুমা আক্তার, নাজনীন ইসলাম, সাবিহা মুস্তফা অর্পা, আব্দুল্লাহ আল আশেক এবং আজলিনা কবির। একইসাথে এ গবেষণায় চীনের নর্থ-ওয়েস্ট এএনএফ ইউনিভার্সিটি এবং নিউজিল্যান্ডের টেক্সটজেন ইনফরমেটিকস নামের একটি সংস্থার ল্যাবরেটরির সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে। 

মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) সকালে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম জুমের মাধ্যেমে কার্প জাতীয় মাছ ও ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন ও হ্যাচারি সম্বলিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ গবেষণার তথ্য জানানো হয়। 

এদিকে, কার্প জাতীয় এ মাছগুলোর জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলে এগুলোর ‘বিশেষত্বের’ দিকগুলো জানা সম্ভব হবে এবং গাঙ্গেয় ডলফিনসহ রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশের জীবনরহস্য উন্মোচন বিশ্বে এটাই প্রথম। তবে এর আগে ভারতের গঙ্গা নদীর রুই ও কাতলার জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন দেশটির গবেষকরা। আর যুক্তরাষ্ট্র উন্মোচন করেছে আটলান্টিক মহাসাগরের ডলফিনের জীবনরহস্য। বিশ্বের জিনোম সিকোয়েন্স বিষয়ক তথ্যভাণ্ডার হিসেবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এনসিবিআইতে (ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন) এ গবেষণার ফল জমা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তা প্রকাশও করা হয়েছে। এর ফলে অন্য দেশের কার্প বা রুই জাতীয় মাছ ও ডলফিনের সঙ্গে হালদার এসব মাছের তুলনা করা যাবে। হালদা নদীর জীববৈচিত্র রক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও গবেষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এসব জলজ প্রাণীর নানা বৈশিষ্ট্যও জানা যাবে।

হালদার চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী গবেষকদল

অন্যদিকে ভারতের গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এই শুশুক বা ডলফিনের বিস্তার। ভৌগোলিকভাবে হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীর অবস্থান অনুযায়ী গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোর সাথে চট্টগ্রামের নদীগুলোর কোন সংযোগ নাই, এমনকি অতীতেও সংযুক্ত থাকার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এরপরও চট্টগ্রামের হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নদীতে গাঙ্গেয় ডলফিন কীভাবে এল— এর বৈশিষ্ট্য কী, এটি কি গঙ্গা নদীর ডলফিনের একটি উপ-প্রজাতি, নাকি স্বতন্ত্র গুণাবলি নিয়ে আলাদা প্রজাতির বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে— বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরে এসব জানার চেষ্টা করছিলেন। আর এই ডলফিনের আগমন, বিস্তৃতি এবং অবস্থান এখনো রহস্যাবৃত। প্রকৃতপক্ষে এই শুশুক বা ডলফিনগুলো, গাঙ্গেয় ডলফিন (Platanista gangetica) প্রজাতির কিনা এবং তাদের উৎপত্তিগত উৎস পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করার মাধ্যমেই জানা যাবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। একই সঙ্গে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এ গবেষণা অন্যতম ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে হালদা গবেষক ও অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘হালদা নদী বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ‘জিন ব্যাংক’। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অত্যাধুনিক পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস একটি খুবই কার্যকর পদ্ধতি যার ফলে মাছের শারীরবৃত্তীয় গবেষণা সম্ভবপর হচ্ছে। কার্প জাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হ্যাচারিতে বড় হওয়া মাছের জেনেটিক পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন তুলনামূলক গবেষণার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিপূর্বে বন্য পরিবেশে বড় হওয়া রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশের কোন পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস করা হয়নি। তাই আমাদের এই গবেষণা হ্যাচারি ও বন্যপরিবেশে বড় হওয়া উক্ত প্রজাতিগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনব্রিডিং সমস্যাসহ পরিবেশগত পরিবর্তন, অসুস্থতা, রোগের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ‘জৈবিকপ্রক্রিয়া’ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।’

কার্প জাতীয় মাছ ও ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে তারা উল্লেখ করেন— ক. অত্যাধুনিক এনজিএস (NGS) প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার সফটওয়্যার (Bioinformatics) এর ব্যবহারের মাধ্যমে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ এবং ডলফিনের একটি ড্রাপ্ট জিনোম ডাটাবেস তৈরি। খ. হালদার কার্প মাছগুলোর গুরুত্বপূর্ণ জিনসমূহ শনাক্ত করণের মাধ্যমে ভবিষ্যত বাণিজ্যিকি করণের স্বার্থে হালদার ব্র্যান্ডিংয়ের কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনেটিক মার্কারের উদ্ভাবন করা। গ. বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের সংরক্ষণের জন্য শারীর বৃত্তীয় তথ্য উপাত্ত সংশ্লিষ্ট জিনসমূহের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা। ঘ. বিবর্তনের উৎস (Evolutionary Origin) হিসেবে হালদার কার্প ও ডলফিনের জিনোমের তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং হালদার কার্প ও ডলফিনের জীববৈচিত্র্য ও সংরক্ষণের স্বার্থে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষকদের মধ্যে সমন্বয় করা।

-সিভয়েস/এসআর

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়