সিনেমা হল শূন্য হচ্ছে চট্টগ্রাম, বাঁচার লড়াইয়ে ‘ঝুমুর’-‘সিনেমা প্যালেস’ 

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
সিনেমা হল শূন্য হচ্ছে চট্টগ্রাম, বাঁচার লড়াইয়ে ‘ঝুমুর’-‘সিনেমা প্যালেস’ 

ছবি: সিভয়েস

বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আলমাস ও দিনার সিনেমা হলের নাম। ১৯৬৫ সালে যাত্রা করা হল দুটি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হতো। তবে ইজারা নিয়ে সেগুলো পরিচালনা করতো বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধুঁকে ধুঁকে চললেও করোনার কারণে ঐতিহ্যবাহী হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে একেবারেই। 

আর কোনোদিন এখানে মুক্তি পাবে না সিনেমা। নাচে-গানে ঝংকার তোলা ভবনটিতে এখন শুনশান নীরবতা। টিকেট কাউন্টারসহ সব ফটকেই ঝুলছে বিশাল বিশাল তালা। নিচে অফিস কক্ষে দু’জন সাবেক কর্মকতা ছাড়া আর কেউ নেই। কর্মচারীদের বিদায় দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। নতুন কেউ এলে বুঝতেই পারবে না, এগুলো একসময় জনপ্রিয় সিনেমা হল ছিল।

তবে প্রায় সিনেমা হল শূন্য হতে যাওয়া চট্টগ্রামের এই অঙ্গনকে এখনো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন একটি পরিবার। সিনেমার প্রতি তাদের টান ও দরদের কারণে রুগ্ন-ভগ্ন এই শিল্পকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুটি সিনেমা হল। ‘ঝুমুর’ আর ‘সিনেমা প্যালেস’ হল দুটির মালিক আবুল হোসেন এখনও তা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আবার চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতিও। বলা চলে, মৃত প্রায় সিনেমা শিল্পকে চট্টগ্রামে বাঁঁচিয়ে রেখেছেন এই আবুল হোসেনই। 

যদিও নগরীতে নতুন করে ২০১৮ সালের আগস্টে নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় ফিনলে স্কয়ারে অত্যাধুনিক ডিজিটাল সিনেমা হল ‘সিলভার স্ক্রিন’ যাত্রা শুরু করে। ৭২ আসনের ‘প্লাটিনাম’ ও ১৮ আসনের ‘টাইটানিয়াম’ হল রয়েছে এ সিনেপ্লেক্সে। প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চারটি শো থাকবে। প্লাটিনামে বাংলা টুডি ছবির টিকিট ৪০০ টাকা, থ্রিডি ৫০০ টাকা এবং নয়টি প্রিমিয়াম সিটের প্রতিটি ৬০০-৭০০ টাকা। বিদেশি ছবি টুডি ৫০০ টাকা, থ্রিডি ৬০০ টাকা। প্রিমিয়াম সিট ৭০০-৮০০ টাকা।টাইটানিয়ামে বাংলাদেশি ছবির টিকিট ১ হাজার ২০০ টাকা এবং বিদেশি ছবির টিকিট ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে সাধারণ হল থেকে তুলনামূলকভাবে টিকিটের দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন পেশার সিনেমাপ্রেমিরা সেই সিনেমা হলে প্রবেশ করতে পারেন না।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, চট্টগ্রামের সিনেমা হলের তালিকা বেশ দীর্ঘ। নব্বই দশকেও সাগরিকা, বনানী, সানাই, আকাশ, উপহার, রিদম, মেলোডি, সঙ্গীত, রঙ্গম, নূপুর, চাঁদনী, কর্ণফুলী, গুলজার, উজালাসহ ছিল ২৭টি। আর তাতেই বোঝা যায়, বন্দর এই নগরীতে কেমন ছিল চলচ্চিত্র ব্যবসা। কিন্তু রূপালী পর্দার সেইসব আজ সোনালি অতীত। সংখ্যাটা কমতে কমতে এখন যেন শূন্যের কাছাকাছি। বর্তমানে মাত্র দুটি সিনেমা হল চালু আছে- নগরীর কে সি রোডের সিনেমা প্যালেস ও কাজীর দেউরীর ঝুমুর (সুগন্ধা)। এগুলোর অবস্থাও ভালো নয়, বন্ধ হওয়ার প্রহর গুনছে। অথচ বছর কয়েক আগেও পাঁচটি সিনেমা হল চালু ছিল চট্টগ্রামে- আলমাস, দিনার, পূরবী সিনেমা ও চালু দুই সিনেমা হল। এর মধ্যে পূরবী সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে দুই বছর ধরে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দর্শক ও ভালো চলচ্চিত্রের অভাবেই মূলত নগরীর গুলজার মোড়ের গুলজার; জেলখানা রোডের রঙ্গম; লালদীঘির খুরশিদ মহল; পাহাড়তলীর আকাশ ও অলঙ্কার; ঝাউতলার নূর জাহান; আতুরার ডিপুর সঙ্গীত; মোহরার কর্ণফুলী; অক্সিজেনের চাঁদনী; দুই নম্বর গেটের রূপালী; হালিশহরের স্যারিসন; টাইগার পাসের নেভি সিনেমা; আগ্রাবাদের সাগরিকা, সানাই, বনানী, উপহার ও রিদম; স্টেশন রোডের উজালা, নূপুর, মেলোডি, জলসা; সদরঘাটের লায়ন; নিউমার্কেটের জলসা; পতেঙ্গার শাহীন সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। 

এর মধ্যে লালদীঘির খুরশিদ মহল সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে মহল মার্কেট, স্টেশন রোডের উজালা ভেঙে করা হয়েছে এশিয়ান এসআর হোটেল, আগ্রাবাদের বনানী সিনেমা হল ভেঙে বনানী কমপ্লেক্স, নিউমার্কেটের জলসা গুড়িয়ে দিয়ে হয়েছে জলসা মার্কেট। এ ছাড়া লায়ন, নূপুর ও রঙ্গম সিনেমা হল ভেঙেও করা হয়েছে বহুতল বিপণী বিতান।

সিনেমা হল মালিকরা বলছেন, ভালো ছবি না এলে এবং পাইরেসি রোধ না হলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প হারিয়ে যাবে। আবার নতুন আধুনিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি সংযোজন করতে অনেক অর্থের দরকার। এ বিষয়ে সরকারও আশ্বাস দিয়েছিল, সিনেমা হলগুলোতে সংস্কার আনবে। কিন্তু আজও সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই হলগুলো ভেঙে নির্মাণ করা হচ্ছে নানা স্থাপনা। কোনোটিতে মার্কেট, কোনোটি বহুতল ভবন, আবার কোনোটি হয়েছে গুদাম।

নগরীর চট্টেশ্বরী রোডের আলমাস ও দিনার সিনেমা হলের সাবেক ব্যবস্থাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল সিভয়েসকে বলেন, ‘আলমাস ও দিনার করোনার আগে থেকেই বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের । মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ভালো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পায়নি বলে এতোদিন কোনরকমভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়। দুটি হলেরই তত্ত্বাবধানে আছে আল হেলাল অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে হলের ভবন ভেঙে ফেলার বিজ্ঞপ্তি ও টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। তাই নয় মাস ধরে এখানে কোনো ছবি আর উঠেনি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই সম্পত্তি সরকারের। তাই সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ও নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য সিনেমা হল থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ব্যয় করতো। কিন্তু লাভের তুলনায় ক্ষতি বেড়ে গেছে শতভাগ। সিনেমা শিল্পের আর ভবিষ্যৎ নেই। এটি আর আলোর মুখ দেখবে বলেও মনে হয় না। করোনার কারণে আরও নাজুক অবস্থা। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নগরীর বাকি হলও।’ 

সরেজমিনে বুধবার (২ ডিসেম্বর) দেখা যায়, করোনার পর ঝুমুর সিনেমা হল খুললেও ‘মাছি মারা’ দশা। দর্শনার্থীর কোনো আনাগোনা নেই বললেই চলে। টিকেট কাউন্টারে তানভীর নামে এক যুবক বসে কেবল মোবাইল চাপছিলেন। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, মালিক পরিবারেরই সদস্য তিনি। হলের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, গ্যালারি খালি। কিছুক্ষণ পর এক দম্পতিকে দেখা গেল টিকিট হাতে ঢুকতে। নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও কথার প্রসঙ্গে পুরুষ দর্শক সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা পোশাক কারখানায় কাজ করি। মাঝে মাঝে এখানে আসি। কিন্তু দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ, নতুন ছবিও এখন আর আসে না।’ 

হলের দায়িত্বে থাকা সাইফ হোসেন সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ২৩ অক্টোবর থেকে হল চালু করি। সাত মাস ধরে সব বন্ধই ছিল, দেশে নতুন সিনেমাও হয়নি তাই ব্যবসায়ও নাই। শুধুমাত্র পারিবারিক ঐতিহ্যের স্বার্থে আমরা নগরীর সিনেমা হল দুটি এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি।’   

পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ আসতেই বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়। সাইফ জানান, নগরীতে এখন যে দুটি সিনেমা হল চালু আছে তার মালিক একজনই। তার নাম আবুল হোসেন, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি। হল দুটি তিনি পেয়েছেন পারিবারিকভাবে। বর্তমানে তার ছেলে সাইফ হোসেন পরিচালনা করেন ঝুমুর। ‘ধর্ম আমার মা’ চলচ্চিত্র দিয়ে এটি ১৯৯৬ সালে যাত্রা করেছিল। আর ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিনেমা প্যালেস জমজমাট থাকলেও বর্তমানে সবদিক থেকে করুণ অবস্থা।  

চালুর পর গত দেড় মাসে ব্যবসার হালচিত্র সম্পর্কে সাইফ হোসেন বলেন, ‘এই সময়ে তিনটা ছবি দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ছবিতেই আশানুরূপ দর্শক পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ছবিটার নায়ক ইমতিয়াজ বর্ষণ চট্টগ্রামের ছেলে হওয়ায় কিছুটা দর্শক পাই। ২৫ হাজারের মতো টিকিট বিক্রি হয়। এর ভিতর অর্ধেক টাকা ছবির পরিচালককেই পাঠিয়ে দিতে হয় আমাদের। বাকি অর্থ দিয়ে এখন মেইনটেনেন্স খরচও পূরণ হয় না। ঝুমুর হলে বর্তমানে চারজন এবং সিনেমা প্যালেসে ১৮ জন কর্মচারী কাজ করে। তাদের বেতন আমাদের অন্যান্য ব্যবসা থেকে যোগান দিতে হয়। এক কথায়, পারিবারিক কারণে ও আমাদের অন্যান্য ব্যবসা ঠিকে আছে বলে এখনো সিনেমা হল দুটো চালিয়ে যাচ্ছি লোকসানের মুখেও। কিন্তু এটা আর কতদিন?’ 

সিনেমা প্যালেস হলের অবকাঠামো ও পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগের বিষয়ে মালিক আবুল হোসেন সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু পারি পরিবেশ ভালো রাখার চেষ্টা করি। অনেকের অভিযোগ স্বীকার করছি, এখানে যৌনকর্মীদের দৌরাত্ম্য বেশি। তবে এ সমস্যা সমাধানে আমরা পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

হিমু বড়ুয়া 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়