পাচার হচ্ছে ঝিঁঝিঁ-তেলাপোকাও

শাহরুখ সায়েল, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৭:৪৯, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
পাচার হচ্ছে ঝিঁঝিঁ-তেলাপোকাও

তক্ষক, হনুমান, বানর, ভাল্লুকসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণী পাচারের কথা সবারই কমবেশি জানা। তবে তেলাপোকা, ঝিঁঝিঁ পোকার মতো পতঙ্গ পাচার হচ্ছে! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিই বাংলাদেশ থেকে পাচারের তালিকায় রয়েছে এসব পতঙ্গ। 

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ২০২০ সালের জুন মাস থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৯১২টি উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে। উদ্ধার করেছে  ১৮২১৭টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তেলাপোকা ও ঝিঁঝিঁ পোকা। 

২০২১ সালের মার্চ মাসের এক অভিযানে দুই প্রজাতির ৩০০০টি তেলাপোকা আর ২০০০টি ঝিঁঝিঁ পোকা উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এছাড়া সেই সাথে ৯টি কঙ্গো রেড অ্যালিগেটর, ব্ল্যাক স্কর্পিয়ন, ৫৫টি শিংওয়ালা ব্যাঙ, ১৪টি লাল দাড়িওয়ালা ড্রাকো টিকটিকি উদ্ধার করে তারা। পাচারকারীর হাত ছাড়াও মিনি চিড়িয়াখানা, বাসা-বাড়ি এবং বিভিন্ন লোকালয় থেকে তারা এসব প্রাণী উদ্ধার করেছে।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বলছে, একেক দেশে একেক ধরনের চাহিদা থাকে। চাহিদা বুঝে কাজ করে অপরাধীরা।

তেলাপোকা-ঝিঁঝিঁ পোকা কেন পাচার হয়, ভোক্তা কারা—

তথ্যপ্রযুক্তি ও দেশি বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম ঘেঁটে জানা গেছে, জাপান, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেলাপোকা, ঝি ঝি পোকা সুস্বাদু খাবার হিসেবে বেশ সমাদৃত। তাছাড়া এশিয়ায় ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরিতেও তেলাপোকা ব্যবহৃত হয়। মুরগি ও মাছ চাষীদের কাছেও তেলাপোকার চাহিদা ব্যাপক।

আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ায় তেলাপোকা চাষের পথিকৃৎ ড্যানিয়েল রোয়েহুরা প্রতি কেজি তেলাপোকা ৫ ইউরোতে বিক্রি করেন। তিনি মূলত পোল্ট্রি খামারি ও মাছ চাষিদের কাছেই সিংহভাগ তেলাপোকা বিক্রি করেন তিনি। তবে মাঝেমধ্যে নিজে খাওয়ার জন্যও কেউ কেউ পতঙ্গটি কিনে নেয়। চীনা খাবার হিসেবে তেলাপোকার ভালো চাহিদা রয়েছে।

তেলাপোকায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন আছে। ফলে প্রোটিনের চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব এই পতঙ্গ খেয়ে। এছাড়া তেলাপোকা থেকে প্রাপ্ত তেলও খুব স্বাস্থ্যকর।

ঝিঁঝিঁ পোকা মেশানো খাবার খেলে মানবদেহে একটি বিশেষ এনজাইমের পরিমাণ বাড়ে এবং প্রোটিনের পরিমাণ কমে। এনজাইমটি পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ফলে ধরে নেওয়া হয় ঝিঁঝিঁ পোকার গুঁড়ো মেশানো খাবারটি পেটের জন্য উপকারি।

২০১৮ সালে চীনা ওষুধ কোম্পানি গুডডক্টর দাবি করে, ওই বছর তেলাপোকা থেকে তৈরি ‘ওষুধ’ বিক্রি করে তারা ৬৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। তবে চীনে তেলাপোকা শুধু ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রোটিনসমৃদ্ধ এই পতঙ্গ কিছু চীনা রেস্তোরাঁয় স্পেশাল রেসিপি হিসেবেও পরিবেশন করা হয়।

চীনের বহু মানুষের বিশ্বাস, তেলাপোকা থেকে তৈরি এসব পণ্য জখম, টাক, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, এমনকি টিউমারের বিরুদ্ধেও ভালো কাজে দেয়। যদিও এ বিশ্বাসের সপক্ষে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কমই আছে। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, নিজেদের দেহে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক থাকে বলেই তেলাপোকা নোংরা পরিবেশেও সুস্থাবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে।

চীনে তেলাপোকা থেকে তৈরি ওষুধের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে গুডডক্টরের প্রতিনিধি ওয়েন জিয়াঙ্গু দাবি করেন, 'ওরাল ও পেপটিক আলসার, ত্বকের ক্ষত, এমনকি পেটের ক্যান্সার সারানোর জন্যও তেলাপোকার নির্যাস উপকারী।'

চীন থাইল্যান্ডের রেস্তোরাঁয় তেলাপোকা ফ্রাই বেশ জনপ্রিয় খাবার। বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্য হিসেবে তেলাপোকা বেশ জনপ্রিয়। পূর্ব এশিয়ায় অনেকে স্ট্রিট ফুড হিসেবে ভাজা তেলাপোকা, তেলাপোকার কাবাব, তেলে ভাজা ঝিঁঝিঁ পোকা খেয়ে থাকেন।

থাইল্যান্ডের হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ফুটপাতের টং দোকানেও পাওয়া যায় তেলে ভাজা ঝিঁঝিঁ পোকা। তেলাপোকার চাটনি থাইল্যান্ডের সুখুমবিট জেলাবাসীর অত্যন্ত প্রিয় খাবার। সুস্বাদু  ও টেকসই প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে অনেক দেশে তেলাপোকা ঝিঝি পোকার চাহিদা রয়েছে।

‘বন্যপ্রাণী ঘিরে অপরাধী চক্র বাংলাদেশে সক্রিয়’

চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে ও বিদেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান জানান, বাংলাদেশ বেশ কিছু বন্যপ্রাণী পাচার হয়। তবে বন্যপ্রাণী পাচারের পথ হিসেবে বাংলাদেশ বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানযোগে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আসে। এগুলো আটকানোর মতো ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে নেই। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনেক কর্মকর্তা কোন প্রাণী আমদানি অবৈধ আর কোনটা বৈধ, তা জানেন না। ফলে এখান দিয়ে বন্যপ্রাণী এনে অন্য দেশে পাচার করা সহজ। মূলত ভারতের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় অনেক বন্যপ্রাণী বাংলাদেশের মাধ্যমে পাচার হয়। আবার ভারত থেকে অনেক বন্যপ্রাণী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে, অন্য দেশে যায়। এটা খুবই মারাত্মক; কারণ, এর মানে হচ্ছে বন্য প্রাণীকেন্দ্রিক অপরাধী চক্র বাংলাদেশে সক্রিয় আছে।

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মাঝখানে আমরা দেখেছি বিরল প্রজাতির সিংহ, পাখি ও প্রাণী বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আটক হয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণ কচ্ছপ পাচার হয়। বৈশ্বিক নানা প্রতিবেদনে এসব বন্যপ্রাণী হত্যাকারী ও চোরাচালানকারী চক্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই চক্রের অনেক গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে আমাদের বন্যপ্রাণী চোরাচালানকারী চক্রের ঠিকমতো বিচার না হলে তাদের এসব কার্যক্রম বন্ধ হবে না।’

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী পাচারের অন্যতম প্রধান রুট

মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বাণিজ্য বিভাগ এবং ইউএসএআইডি-র সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুত করা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত বন্যপ্রাণী পাচার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন 'এলিমিনেট, নিউট্রালাইজ অ্যান্ড ডিসরাপ্ট'-এর (ইএনডি) তথ্যানুসারে, বিশ্বের যে ২৮টি দেশকে বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য কিংবা তাদের তাদের থেকে তৈরি পণ্যের প্রধান উৎস এবং বড় ভোক্তা বলে বিবেচনা করা হয়, বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য বা তাদের থেকে তৈরি পণ্যের অন্যতম প্রধান ট্রানজিট পয়েন্টও বাংলাদেশ।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের 'এলিমিনেট, নিউট্রালাইজ অ্যান্ড ডিসরাপ্ট' নামক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছাড়াও ব্রাজিল, বার্মা, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুন, চীন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, গ্যাবন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, লাওস, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র , দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, টোগো, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনাম, এবং জিম্বাবুয়ের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বন্যপ্রাণী পাচার একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ যা নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আইনের শাসন, দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং জুনোটিক রোগের বিস্তারের মাধ্যমে মানব স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

 যা বলছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

২০২১ সালের মার্চ মাসের এক অভিযানে দুই প্রজাতির ৩০০০টি তেলাপোকা আর ২০০০টি ঝিঁ ঝিঁ পোকা উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। কোথায় পাচার হচ্ছিল পোকাগুলো এমন প্রশ্ন করা হলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মোঃ ছানাউল্যা পাটওয়ারী জানান, এয়ারপোর্ট দিয়ে পাচারের সময় কিছু বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছিলো। যেগুলোর সাথে খাবার হিসেবে তেলাপোকা ও ঝিঁঝিপোকাগুলো ছিল। যেহেতু পাচারকৃত বা পাচার হতে যাওয়া বন্যপ্রাণী গুলো আমরা আটক করেছি জব্দ করেছি একই সাথে তেলাপোকা, ঝিঁঝিপোকাগুলোও আমরা জব্দ করেছি যেহেতু এগুলো ওয়াইল্ড লাইফ প্রাণী ছিল। যেহেতু এগুলো প্রানী ছিল তাই সেগুলো আমরা জব্দ করেছি। যেহেতু প্রানীগুলো ফুড হিসেবে যাচ্ছিল সেক্ষেত্রে আমরা এগুলো জব্দ তালিকায় তালিকাভুক্ত করেছি।

তেলাপোকা ও ঝিঁঝিপোকা পাচার নিয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, একেক দেশের ডিমান্ড একেক ধরনের হয়। সাধারনত এয়ারপোর্টেই এগুলো বেশি ধরা হয়। অবৈধভাবে পাচারকালে এগুলো এয়ারপোর্টে আটক করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এগুলো আটক করা হয়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের ডিমান্ড থাকে সেই ডিমান্ডের উপর বেইজ করে অপরাধী চক্র পাচার করে। অপরাধী চক্র তো সাধারণত তাদের লাভের জন্যই পাচার করে। অর্থের বিনিময়েই তারা এসব পাচার করে।

ধুঁকে ধুঁকে চলছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনের লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৩১ ধারা মোতাবেক জুন ২০১২ সালে গঠন করা হয় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। 

স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন প্রকল্পের আওতায় ১৭ জন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ইউনিটটিতে কর্মরত আছেন ১৪ জন। যাদের মধ্যে এনফোর্সমেন্ট অপারেশন পরিচালনার জন্য আছেন মাত্র ৬ জন কর্মকর্তা। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক বলছেন তাদের বেসিক্যালি পটেনশিয়াল পার্সন ২৭ জন। প্রয়োজনীয় লোকবল ও উদ্ধার সরঞ্জামের অভাবে অনেকটা ধাক্কা দিয়েই চালাতে হচ্ছে ইউনিটটিকে।

ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেই পর্যাপ্ত যানবাহন। আছে চালক ও তেল সংকট। উদ্ধার বা জব্দ করা বন্যপ্রাণী পরিবহনের জন্যও নেই কোনো বিশেষ ব্যাবস্থা। উদ্ধার সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক  মোঃ ছানাউল্যা পাটওয়ারী জানান, বন্যপ্রানী আইনের আওতায় একটি প্রজেক্ট হিসেবে এই ইউনিটটি সৃষ্টি হয়। নিজেদের জনবল সংকট, পরিবহন অপর্যাপ্ততা এবং তেল সংকট আছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ইউনিটটি সরকারের রাজস্ব খাত ভূক্ত নয়। বিভিন্ন  প্রোজেক্টের মাধ্যমে খরচ আসে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি এটিকে মেইন অর্গানোগ্রামে নেয়ার। রেভিনিউর আওতায় নেয়া। বন বিভাগের মেইনস্ট্রিমে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। আমাদের জনবল সংকট, পরিবহন সংকট, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেহেতু এই ইউনিটটির জন্মের ইতিহাস হলো একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট হিসেবে। তারপরও এটি এদিক ওদিক করে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। বলা যায় স্যালাইন ট্যালাইন দিয়া, ধাক্কা ধোক্কা দিয়ে বাচিয়ে রাখা হচ্ছে। তারপরও আমাদের যে জনবল তা কম হলেও ফাংশনাল তাই এখনও এই ইউনিটটি টিকে আছে। ভবিষ্যতে ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা আছে তারপরও শুরু যেহেতু হয়েছে ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার সুযোগ আছে।’ 

বন্যপ্রাণী ফরেনসিক ল্যাব

২০১৬ সালে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তত্ত্বাবধানে স্থাপন করা হয় ফরেনসিক ল্যাব। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বন্যপ্রাণীদেরকে নিরাপদ করার জন্য বন্যপ্রাণীর অপরাধ উদঘাটন, তদন্ত ও মামলা পরিচালনা করার লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটকে সঠিক তথ্য ও দিক নির্দেশনা প্রদান করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে সেখানেও আছে সীমাবদ্ধতা আর কর্মী সংকট। উর্ধ্বতন ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে মাত্র একজন কর্মকর্তা দিয়েই চলছে ল্যাবটি। ফরেনসিক ল্যাবে জেনেটিক্যাল কোড এবং ডিএনএর মাধ্যমে প্রাণীর প্রজাতি সনাক্ত করতে পারলেও। তারা কেমিক্যাল এনালাইসিস করতে পারে না। সেক্ষেত্রে পুলিশের বিশেষ শাখা অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) সহায়তা নিতে হয়।

এদিকে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বলছে, ফরেনসিক প্রযুক্তিকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রয়োগ করে DNA প্রোফাইল ও DNA সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে ফৌজদারী অপরাধ সনাক্ত করে ফৌজদারী প্রমান হেফাজতে রাখা এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন সম্ভব হচ্ছে ল্যাবটির মাধ্যমে। মূলত এটি একটি আধুনিক প্রযুক্তি যা বন্যপ্রাণীর অপরাধ উদঘাটনে সহায়তা করছে এবং কনজারভেশন জেনেটিক্স ও আইন প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করছে।

ক্রাইমের হটস্পট নিয়ে কি বলছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

দেশের ২৮টি পয়েন্টকে বন্যপ্রাণী পাচার এবং ক্রাইমের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। তবে ইউনিটটির পরিচালক একটু ভিন্ন ভাবে বলেন, ক্রাইমের হটস্পট একটা পপুলেশনের হটস্পট আরেকটা। হিল ট্রাকটা আমরা এখনও ওভাবে নিতে পারিনাই। কিন্তু হিলেই তো বন্য প্রাণী ধরে খায়৷ তারা আবার বেচাকেনা অথবা পাচার হয়তো ওভাবে করে না। তারা খায় কিন্তু পাচার করে না। তারা ইদুর থেকে শুরু করে শিয়াল, বিড়াল, গুইসাপ সবই খায়। কিন্তু ঐটাকে আমরা হটস্পট হিসেবে ঐভাবে আইডেন্টিফিকেশন করতে পারিনা। কারন হলো ওরা মার্কেটিং এ না গিয়ে ওরা কনজিউম করে। কনজিউমার হিসেবে। বাংলাদেশ যেহেতু বায়োডাইভারসিটি হিসেবে একদিকে সমৃদ্ধ আরেকদিকে এথেনিক গ্রুপের লোক আছে আবার বিভিন্ন ধর্মের লোক আছে আবার ওয়াইল্ড লাইফ খাওয়ার লোকও আছে। আবার ট্রানজিট হিসেবেও আমাদের দেশ ব্যবহার হয়। তিনটা ইভেন্টেই আমাদের ইমপ্যাক্ট আছে। এজন্য হলিস্টিক এপ্রোচ যেটা বলে সবাই মিলে সচেতন ভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। অস্ত্র দিয়ে, আইন দিয়ে, ধমক দিয়ে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম

বন্যপ্রাণী শিকার, মারা ও ক্রয়-বিক্রয় রোধকরণ, বন্যপ্রাণী অপরাধ সম্পর্কিত অপরাধী শনাক্তকরন, মামলা দায়ের ও পরিচালনা, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও গনসচেতনতা সৃষ্টি, দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পথে বন্যপ্রাণীর পাচার রোধ ইউনিটটির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

বন্যপ্রাণী শিকার, পাচার, মারা ও ক্রয়-বিক্রয় জনিত অপরাধ দমনে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এ বর্ণিত শাস্তির বিধান প্রয়োগ ও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন। বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে হটস্পট সমূহ (hot spots) চিহ্নিত করণ এবং সকল স্পটে নিয়মিত টহল প্রদান। বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য রোধকল্পে হাট-বাজার ও পাখি সমৃদ্ধ হাওড় এলাকায় নিয়মিত টহল প্রদান। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীসমূহ হতে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। পাচারের সময় আটককৃত বন্যপ্রাণীর দেহাবশেষ বা ট্রফি থেকে প্রজাতি শনাক্তকরণ। বন্যপ্রাণী বিষয়ক অপরাধের মূল তথ্য উদঘাটন ও অপরাধীকে শনাক্তকরণ। উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণী তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে অবমুক্ত করা। বন্যপ্রাণীর পাচার রোধকল্পে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় বিদ্যমান বন্যপ্রাণী বিষয়ক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা। আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় রক্ষা করে বন্যপ্রাণীর পাঁচার রোধ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে দাবি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের।

জুন ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২০

জুন ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২০ এই ৬ মাসে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট অভিযান চালায় ৩৬৩ টি। সেসব অভিযানে উদ্ধার হয় ১৯৫৭টি বন্যপ্রাণী। যার মধ্যে ১৬৩০টি পাখি (৮৩ শতাংশ)। তাছাড়া কড়ি কাইট্টা (কচ্ছপ) ৯টি, কচ্ছপ ১৬টি, তক্ষক ৬টি, রাজ কাঁকড়া ১টি, ঘড়িয়াল ২টি, টিকটিকি ৩টি, শুশুক ২টি, মেছোবাঘ ২০টি, বানর ৬৭টি, লজ্জাবতী বানর ১টি, মেছোবিড়াল ১টি, বনবিড়াল ১৪টি, চিতাবিড়াল ১টি, বেজি ৪টি, বাগদাশ ১টি, ভোঁদড় ১টি, বনরুই ২টি, গন্ধগোকুল ২৭টি, বাঘাইর ১টি, শিয়াল ২টি, সাপ ৭৩টি, গুঁইসাপ ১২টি, রামগুঁই ৩টি, হনুমান ৪৮টি, মায়া হরিণ ১টি উদ্ধার করা হয়েছে।

২০২১ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২১

২০২১ সালে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট অভিযান পরিচালনা করেছে ৫৬১টি। সেসব অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৮৫২৫টি প্রাণী। এরমধ্যে ২৩২৩টি পাখি। এছাড়া কাঠবিড়ালি ৫টি, কড়ি কাইট্টা (কচ্ছপ) ২৫টি, একিউরিয়াম কচ্ছপ ৩৫০টি, কচ্ছপ ১৩৭টি, সুন্ধি কাছিম ৪৫টি, ঘড়িয়াল ১টি, লোনা পানির কুমির ১টি, তক্ষক ৪৯টি, ড্রাকো (উড়ন্ত টিকটিকি) ১৪টি, শুশুক ৪টি, বাদুড় ৫টি, তেলাপোকা (তুর্কি) ২৫০০টি, তেলাপোকা (ডুবাই) ৫০০টি, ঝিঁঝিঁ পোকা ২০০০টি, বিচ্ছু ৯টি, মেছোবাঘ ২টি, বানর ৮১টি, লজ্জাবতী বানর ১টি, উল্লুক ১টি, মেছোবিড়াল ২২টি, বনবিড়াল ৫০টি, চিতা বিড়াল ৫টি, বেজি ২টি, সজারু ১২টি, বনরুই ১টি, হগ-বেজার ১টি, বিন্টুরং ২টি, গন্ধগোকুল ৩৫টি, শিংওয়ালা ব্যাঙ ৫৫টি, ভাল্লুক ১টি, শিয়াল ১৬টি, শিয়ালের বাচ্চা ১৭টি, সাপ ১০৫টি, গুঁইসাপ ১৯টি, রামগুই ১টি, ঢোঁড়া সাপ ৮২টি, অজগর ৫টি, ঘরগিন্নি সাপ ১টি, কলম্বিয়ার অজগর ১টি, হনুমান ২৯টি, হরিণ ১টি, মায়া হরিন ৬টি এবং ৩টি চিত্রা হরিণ উদ্ধার করা হয়।

জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২২

২০২২ সালে ৬১০টি অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৪০৪৪টি প্রাণী। এরমধ্যে পাখি উদ্ধার করা হয়েছে ৩২৪০টি। তাছাড়া কাঠবিড়ালি ৩টি, কড়ি কাইট্টা (কচ্ছপ) ১২৯টি, কচ্ছপ ৫টি, সুন্ধি কাছিম ১২১টি, লোনা পানির কুমির ১টি, তক্ষক ২০টি, গিরগিটি ১টি, নীলগাই ১টি, হাতি ১টি, শুকর ১টি, বানর ৬৪টি, বাদামী বানর ১টি, লজ্জাবতী বানর ৪টি, মেছোবিড়াল ১৬টি, বনবিড়াল ৩৯টি, বেজি ৮টি, ভোঁদড় ১টি, সজারু ১টি, বনরুই ১টি, গন্ধগোকুল ৩৬টি, সবুজ ব্যাঙ ১৫০টি, ভাল্লুক ১টি, বাঘাইর ১টি, ডলফিন ১টি, শাপলা পাতা মাছ ২টি, শিয়াল ২৮টি, সাপ ১৩৩টি, গুঁইসাপ ১৯টি, হনুমান ৯টি, হরিণ ১টি, মায়া হরিন ২টি, চিত্রা হরিণ ১টি এবং ১টি সাম্বার হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে।

জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩

২০২৩ সালে ৩১৬টি অভিযান পরিচালনা করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। সেসব অভিযানে বছর জুড়ে তারা উদ্ধার করেছে ৩৩৯০টি প্রাণী। এরমধ্যে পাখি ২৫৯৩টি। এছাড়া কাঠবিড়ালি ১২টি, কড়ি কাইট্টা (কচ্ছপ) ৪২১টি, কচ্ছপ ১৩৭টি, সুন্ধি কাছিম ২১টি, তক্ষক ৭টি, বন্য শুকর ১টি, গ্রিবেট বানর ৪টি, লজ্জাবতী বানর ৮টি, মেছোবিড়াল ৮টি, বনবিড়াল ২৫টি, বেজি ১টি, ভোঁদড় ২টি, সজারু ১টি, হুগ-বেজার ১টি, গন্ধগোকুল ১১টি, ভাল্লুক শাবক ২টি, শাপলা পাতা মাছ ৫টি, শিয়াল ১২টি, সাপ ৪৮টি, গুঁইসাপ ৬টি, হনুমান ৩টি, মুখপোড়া হনুমান ১টি, চশমাপড়া হনুমান ১টি, হরিণ ৯টি এবং ১টি চিত্রা হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে।

২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস

২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ৬২টি অভিযান পরিচালনা করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। সেসব অভিযানে তারা উদ্ধার করেছে ৩০১টি প্রাণী।

জানুয়ারি মাসে ২২টি অভিযান চালিয়ে ১৫৭ টি আর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭টি অভিযান চালিয়ে ২৯টি বন্যপ্রাণী এবং মার্চ মাসে ২৩টি অভিযান চালিয়ে ১১৫টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এরমধ্যে পাখি ২৪৯টি। এছাড়া কচ্ছপ ২টি, বানর ৬টি, মেছোবিড়াল ১টি, বনবিড়াল ১২টি, বেজি ১২টি, গন্ধগোকুল ৮টি, শাপলা পাতা মাছ ২টি, সাপ ৩টি, গুঁইসাপ ১টি, হনুমান ২টি, বেজি ১২টি, কুমির ১টি এবং ২টি উড়ন্ত টিকটিকি উদ্ধার করা হয়েছে।

বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অধীনে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে নয়টি। বছরটিতে মোট অপরাধীর সংখ্যা ছিল ২৮ জন। বন্য প্রাণীসংক্রান্ত মোট অপরাধ ঘটেছে ৫৪৯টি। জব্দ করা মোট প্রাণী ছিল ৩ হাজার ৭৮৫টি। জব্দ করা মোট ট্রফি ছিল ১৬৯টি। দুটি বিনোদনমূলক পার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়